এক সপ্তাহের ব্যবধানে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাটির নিচে দুটি বিশালাকারের বোমা। বিমানবাহিনী জানিয়েছে সেগুলো মুক্তিযুদ্ধকালীন। কিন্তু এখানে কেন?
মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট শামছুল আলম (বীর উত্তম) ধারণা করছেন, ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বরের পর ভারতীয় বিমানবাহিনী যে হামলা করে, তখন এই বোমাগুলো পড়তে পারে।
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী পশ্চিমবঙ্গে বিমান হামলা করলে ভারত সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করে। এর আগে ভারত ছিল মুক্তিযুদ্ধের সহযোগীর ভূমিকায়।
ভারত যুদ্ধ ঘোষণার পর গঠন হয় ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনী। আর ভারতীয় পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনী ভারী অস্ত্র নিয়ে স্থল হামলার পাশাপাশি বিমান হামলাও চালায়।
ঢাকায় ভারতীয় বিমানবাহিনীর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানিদের বিমান ঘাঁটি তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা ঘাঁটির রানওয়ে ক্ষতিগ্রস্ত করা। ৪ ও ৫ ডিসেম্বরের এই হামলায় পাকিস্তানি বাহিনী পর্যদুস্ত হয়ে পড়ে।
রাতের বেলায় এই হামলার সময় কিছু বোমা লক্ষ্যচ্যুত হয়ে জলাভূমিতে পড়ে বলে জানান মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের বিমান বহর কিলো ফ্লাইটের বীর সেনা শামছুল আলম। তার ধারণা, থার্ড টার্মিনাল করার জন্য পাইলিং এর সময় আরও বোমা পাওয়া যেতে পারে।
বোমা পাওয়ার পর বিমানবাহিনীর দুই বিশেষজ্ঞ সেটিকে নিষ্ক্রিয় করেন
পাইলিংয়ের সময় প্রথমে গত ৯ ডিসেম্বর ২৩০ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া যায় মাটির ১৫ ফুট নিচে। এ নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে সোমবার পাওয়া যায় একই আকৃতির আরও একটি বোমা।
ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট (অব.) শামছুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার পর ৪ তারিখ (ডিসেম্বর) থেকে ভারতীয় বিমান বাহিনী ঢাকায় কয়েকটি হামলা করে। এর মধ্যে তেঁজগাও বিমানবন্দরও ছিল। আমার ধারণা, এই বোমা দুটি সেই অপারেশনেরই। নরম জায়গায় পড়েছিল তাই ফাটেনি। আবার তখন ভারতীয় বিমান বাহিনীর বোমাগুলো অনেক পুরনো ছিল সেটাও কারণ হতে পারে।’
মুক্তিযুদ্ধের সময় চট্টগ্রামের পতেঙ্গার ইস্টার্ন রিফাইনারির তেল ডিপোতে হামলা করেছিলেন এই বিমান সেনা। নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি বলেন, ‘আমার দুই দফায় লঞ্চ করা চারটি রকেটই ফাটেনি। তৃতীয়বার ঘুরে এসে যখন রকেট ছুড়লাম, সেটা ব্লাস্ট করল। এমনটা হওয়া খুবই স্বাভাবিক। সজোরে আঘাত লাগলেই ব্লাস্ট করবে, এটাই বোমার স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিন্তু তা যদি নরম মাটি, বালি, অথবা পানিতে পড়ে তাহলে তা অবিস্ফোরিত থাকতে পারে।
‘এখন তো দুটি পাওয়া গেছে, সামনে আরও মিলবে তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।’
বাংলাদেশের বহর কিলোফ্লাইট থেকে এই বোমা পড়েনি সেটা কীভাবে বুঝবেন- এমন প্রশ্নে এই মুক্তিযোদ্ধা বলেন, ‘কিলো ফ্লাইটের অটার বিমানে আমরা এ ধরনের বোমা ব্যবহার করিনি। আর ঢাকায় আমরা অ্যাটাকও করিনি। তাই এগুলো যে আমাদের ফেলা না, তা আমি শতভাগ নিশ্চিত।
‘মুক্তিযুদ্ধের সময় ভারতীয় বাহিনী মূলত মিগ-২১ এবং ক্যানবেরা বিমান ব্যবহার করেছিল। যে বোমা দুইটি উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলো সম্ভবত ক্যানবেরা বিমান থেকে ফেলা হয়েছিল।’
কিলো ফ্লাইটের আরেক সদস্য ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন আহমেদ (বীর উত্তম) নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যুদ্ধের সময় মূল বিমানবন্দরগুলোতে হামলা চালানোর কাজটি করেছিল ভারতীয় বিমান বাহিনী। কারণ বাংলাদেশের বিমান বাহিনীর তখনও মূল বিমানবন্দরে হামলা চালানোর মতো সক্ষমতা ছিল না। আমাদের যে হেলিকপ্টার ছিল তার গতি ছিল ৮০ মাইল। যে অটার বিমানটি ছিল সেটার গতি ছিল সর্বোচ্চ ১১০ মাইল। এগুলো নিয়ে হামলা চালানো খুবই বিপজ্জনক ছিল।’
গত ৯ ডিসেম্বর ২৩০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার হয় শাহজালালের মাটির নিচে
তিনি বলেন, ‘৩ ডিসেম্বর ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে শত্রুদের জ্বালানি সরবরাহের যে ডিপোগুলো ছিল সেখানে হামলা চালিয়েছিল বাংলাদেশের বাহিনী। চট্টগ্রামে বিমানবন্দরের কাছেও একটি ডিপো ছিল সেটিও উড়িয়ে দেয়।
‘এই হামলা চালানোর পরের দিন অর্থাৎ ৪ ডিসেম্বর ভোরে ভারতীয় বিমান বাহিনী বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধান তিনটি বিমানবন্দর ঢাকা, চট্টগ্রাম, যশোরে বিমান হামলা চালায়। ওই হামলা চালানোর সময় হয়তো উদ্ধার হওয়া বোমা দুটি ব্যবহার করা হয়েছিল’-বলেন তিনি।
ক্যাপ্টেন সাহাবুদ্দিন জানান, ২০০ বা ২৫০ কেজি ওজনের বোমাগুলো মূলত কোন স্থাপনা ধ্বংসের কাজে বা কোন ঘাঁটি লক্ষ্য করে বড় ধরনের ধ্বংসযজ্ঞের জন্য নিক্ষেপ করা হয়ে থাকে। বিমান বন্দরের রানওয়েতে যদি এই বোমা ফেলা হয় তাহলে সেখানে বড় ধরনের গর্ত তৈরি হয়, ফলে রানওয়ে পুরোপুরি অকেজো হয়ে পড়ে। তখন শত্রুপক্ষের বিমান ওঠা-নামা করতে পারে না।