শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের শ্রদ্ধা জানানোর দিন অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার পাশাপাশি দেশ থেকে মৌলবাদীদের সমূলে উৎপাটনের অঙ্গীকার উঠে এসেছে।
সোমবার সকালে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে এসে দেশে মৌলবাদী রাজনীতি প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম চেতনাই ছিল অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, বাঙালি জাতীয়তাবাদ। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির লক্ষ্য নিয়ে জাতির পিতার নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করেছিলাম।’
এবার শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস পালিত হচ্ছে এমন এক সময়ে যখন কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক শক্তির একটি অংশ জাতির পিতার ভাস্কর্য নির্মাণকে সামনে রেখে শক্তি দেখানোর চেষ্টা করছে।
রাজধানীর ধোলাইপাড়ে এই ভাস্কর্য নির্মাণ হলে বুড়িগঙ্গায় টেনেহিঁচড়ে ফেলে দেয়ার হুমকির মধ্যে কুষ্টিয়ায় নির্মাণাধীন একটি ভাস্কর্যে ভাঙচুরও করা হয়েছে।
এই ঘটনায় তীব্র ক্ষোভের মধ্যে মাঠে নেমেছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠন।
এর মধ্যে আবার দেশ জুড়ে প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এমনকি বিচারকরা মাঠে নেমে জাতির পিতার সম্মান অম্লান রাখার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের জাতির পিতা, তার ওপর যে কোনো হামলা জাতির ওপর হামলা হিসেবে দেখা হবে।
এর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় একটি ওয়েবিনারে বলেছেন, একাত্তরে যেভাবে রাজাকারদের প্রতিরোধ করা হয়েছে, তেমনি এখন হেফাজতের মৌলবাদী গোষ্ঠীকেও মোকাবিলা করা হবে।
শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবসের বাণীতে প্রধানমন্ত্রীও মৌলবাদ রুখে দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমি দল মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে একাত্তরের ঘাতক, মানবতাবিরোধী, যুদ্ধাপরাধী জামায়াত-মৌলবাদী চক্রের সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানাচ্ছি।’
মিরপুর স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, মৌলবাদকে প্রতিহত করা সহজ নয়। তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর জিয়াউর রহমান, এরশাদ ও খালেদা জিয়া মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষকতা করে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনা করেছে। মৌলবাদীদের শেকড় অনেক গভীরে। তাই এক কথায় এদের মূলোৎপাটন করা সম্ভব নয়।’
তবে বর্তমান সরকারের অধীনে মৌলবাদ উৎপাটনে সবাই একাট্টা হয়েছে বলে মনে করেন মন্ত্রী। বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এদের মূলোৎপাটন করার জন্য জাতি কীভাবে ঐক্যবদ্ধ সেটা নিশ্চয় আপনারা লক্ষ্য করেছেন।
‘বঙ্গবন্ধু শিখিয়ে গেছেন আইন হাতে তুলে না নেয়ার জন্য। তাই আমরা কোনো পর্যায়েই ওদের বিরুদ্ধে আইন হাতে তুলে নেই নাই। আমাদের চেতনা দিয়ে, মুক্তিযুদ্ধের মূলনীতিতে উজ্জীবিত হয়েই রাজনৈতিকভাবে এই বিষফোঁড়া উপড়ে ফেলার জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ আছে।’
শিগগিররই রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ করা হবে বলেও জানান মন্ত্রী।
বলেন, ‘এই তালিকা করার সময় যাতে কারও প্রতি আক্রোশের বশবর্তী না হই, আবার কারও প্রতি বাড়তি ফেভার বা আনুকূল্য দেখানোর জন্য কাউকে যেন বাদ দেওয়া না হয়, অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে আমরা যেন তৃণমূল থেকে এ তালিকা করতে পারি, আইন পাস করার পরে সেভাবে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সরকারপ্রধান নীতি নির্ধারণ করেন। উনি এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন।…তবে আইন হোক বা না হোক, আমরা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিকে ঘৃণা করি, প্রত্যাখান করি ও এর বিরোধিতা করি।’
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ যখন বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে তখন পরিকল্পিতভাবে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ জাতির শ্রেষ্ঠ নাগরিকদের তুলে নিয়ে নির্বিচারে হত্যা করে পাকিস্তানি বাহিনীর এ দেশীয় দোসর আলবদর।
জামায়াতে ইসলামীর সে সময়ের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের গঠন করা এই খুনি বাহিনীর সে সময়ের দুই প্রধান মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ ছাড়াও ফাঁসিতে ঝুলেছেন মীর কাসেম আলী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান। আরেক আলবদর নেতা এ টি এম আজহারুল ইসলামের দণ্ড কার্যকর সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
তবে আলবদর বাহিনীর কুখ্যাত দুই নেতা চৌধুরী মুইনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান বিদেশে অবস্থান করায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা যাচ্ছে না।
এই খুনিরা যাদের হত্যা করেছিল, তাদেরকে সম্মান জানাতে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর পালিত হয় শহিদ বুদ্ধিজীবী দিবস হিসেবে।
প্রতি বছরই এই দিনে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী নিজে উপস্থিত থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে এবার তা হয়নি।
সকাল সাতটা ১০ মিনিটে মিরপুর শহিদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম শামীম উজ জামান। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী।