পুরান ঢাকার প্রায় প্রতিটি বাড়ি আর অপরিসর গলিতে ওত পেতে আছে মৃত্যু। কোনো বাড়ির নিচ তলায় রাসায়নিকের গুদাম, কোনোটিতে রাবারের স্যান্ডেল বা প্লাস্টিকের কারখানা। আবার কোথাও প্লাস্টিক দানা, ফোম, নকল প্রসাধন ও পারফিউম তৈরির সরঞ্জামের মতো উচ্চ মাত্রার দাহ্য পদার্থ মজুত করে রাখা।
এক দশক আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের আগুনে পুড়ে মারা যান ১২৪ জন। এরপর গত বছরের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে চকবাজারের চুড়িহাট্টায় একই ধরনের দুর্ঘটনায় ৭০ জনের মৃত্যু হলেও পুরান ঢাকার ঝুঁকির চিত্র বদলায়নি।
এখনও বংশাল থেকে চকবাজার, আরমানিটোলা থেকে সিদ্দিকবাজার, মালিটোলা থেকে আগামসীহ লেন কিংবা মিডফোর্ড এলাকায় একই দৃশ্য। কোথাও দিনভর ঝাঁঝালো গন্ধ, কোথাও হাতুড়ি পেটানো অথবা যন্ত্রের বিরক্তির শব্দের মধ্যেই বসবাস করছেন লাখো মানুষ।
নিমতলী আগুনের পর এ এলাকা থেকে রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের গুদাম সরানোসহ ১৭টি সুপারিশ করেছিল সরকারি তদন্ত কমিটি। তবে এর কোনোটিই বাস্তবায়ন হয়নি।
এরপর গত বছর চুড়িহাট্টার বিভীষিকাময় আগুনের পর রাসায়নিকের গুদাম অস্থায়ীভাবে শ্যামপুর ও টঙ্গীতে সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগেও তেমন অগ্রগতি নেই।
২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি আরেক সিদ্ধান্ত অনুসারে, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিকের ব্যবসার নতুন ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ করা হয়। সেইসঙ্গে রাসায়নিক ও পেট্রোলিয়াম জাতীয় দাহ্য পদার্থ আবাসিক এলাকায় সংরক্ষণ বা গুদামজাতের অনুমতি বন্ধ এবং এসব ব্যবসার আগের লাইসেন্স বাতিলেরও সিদ্ধান্ত হয়। তবে সে সবেরও বাস্তবায়ন নেই, পুরান ঢাকা চলছে আগের মতোই।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার অনোয়ারুল ইসলামের সভাপতিত্বে গত ৮ অক্টোবর ১৫টি মন্ত্রণালয়, সংস্থা, বিভাগ, অধিদফতরের এক বৈঠকেও উঠে এসেছে হতাশাজনক চিত্র।
সরেজমিনে পুরান ঢাকা
চুড়িহাট্টায় আগুনের পর পুরান ঢাকা থেকে রাসায়নিকের গুদাম অপসারণে টানা ১১দিন অভিযান চালিয়েছিল বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে নিয়ে গঠিত টাস্কফোর্স। সে সময় ২০১৯ সালের ৪ মার্চ ইমামগঞ্জের ৫৪/৫ নম্বর হোল্ডিংয়ের নিচতলায় রাসায়নিকের গুদাম সিলগালা করা হয়। তবে সম্প্রতি সেখানে গিয়ে আবারো বিভিন্ন রাসায়নিকের মজুত দেখেছেন নিউজবাংলার প্রতিবেদক।
ইমামগঞ্জ থেকে মিটফোর্ড রোডে ঢুকতেই নাকে ভেসে আসে রাসায়নিকের ঝাঁঝালো গন্ধ। এই সড়কের দুই পাশে সারিবদ্ধভাবে রয়েছে শত শত রাসায়নিক ও সুগন্ধির দোকান।
বেড়িবাঁধ থেকে ঢাল বেয়ে নেমে যে সড়কটি ইসলামবাগের দিকে গেছে, তার দুই পাশের বাড়িগুলোর পুরোটা অথবা একাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে কারখানা, গুদাম বা দোকান হিসেবে। এ ছাড়া উর্দু রোড, ওয়াটার ওয়ার্কস রোডেও রয়েছে অনেক রাসায়নিক ও প্লাস্টিকের কাঁচামালের দোকান।
চাঁদনীঘাট এলাকার অপরিসর গৌর সুন্দর দাস লেনে পাশাপাশি দুটি রিকশা চলার উপায় নেই। এই লেনের মুখোমুখি দুটি বাড়ির নিচতলায় অন্তত পাঁচটি প্লাস্টিক ও লোহার ডাইস তৈরির কারখানা দেখতে পেয়েছে নিউজবাংলা। পথের মাঝে ঠেলাগাড়ি থামিয়ে ৭/১ নম্বর বাড়ির নিচতলার গুদামে পলিথিন ভর্তি বস্তা নিয়ে যাচ্ছিলেন দুই জন শ্রমিক।
ইসলামবাগ এলাকায় দেখা যায়, সেখানে গড়ে উঠেছে প্রচুর রাবার, প্লাস্টিক ও স্যান্ডেল-জুতা তৈরির কারখানা। এ ছাড়া এসব পণ্যের কাঁচামাল- যেমন বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিকের গুটি, রং ইত্যাদির দোকান এবং গুদামও রয়েছে। আছে প্লাস্টিকের গুদাম, প্লাস্টিক পুনঃপ্রক্রিয়াকরণ কারখানা।
এলাকার বাসিন্দারা জানান, এসব কারখানা ও গুদামের বেশির ভাগেরই অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ও ফায়ার লাইসেন্স নেই।
কায়েৎটুলির বাসিন্দা মো. দেলোয়ার হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লোভ তো কারুর কম না। ঘুষ খায়া ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স দেয় সিটি করপোরেশন। আর বেশি ভাড়া পাওয়ার লোভে বাড়িতে কারখানা বসাইতে দেয় বাড়িওয়ালা। তারা যদি কারখানা বা গুদামের জন্য বাড়ি ভাড়া না দিত তাইলে এই অবস্থা হইত না।’
সিদ্দিকবাজারের মো. সালাউদ্দীন বলেন, ‘সিদ্দিকবাজারে বেশিরভাগ বাড়িতে আপনি কারখানা পাইবেন। মুদি দোকানের জন্য জায়গা ভাড়া দিলে পাঁচ হাজার টাকার বেশি আসে না, কিন্তু গুদাম করতে দিলে পাওয়া যায় বিশ হাজার টাকা।’
কে বি রুদ্র রোডের হাজী শফিউল্লাহ আক্ষেপ নিয়ে বলেন, ‘২০১৪ সালেও আগা সাদেক রোডে একটা কারখানায় আগুন লেগে সাত জন মারা গেছে। তারপরেও ওই বাড়িওয়ালা আবার সেই জায়গা গুদামের জন্য ভাড়া দিয়েছেন।’
বাসিন্দারা জানান, পুরান ঢাকার মানুষ প্রতি মুহূর্তে আগুনের ঝুঁকিতে থাকেন। চূড়িহাট্টার দুর্ঘটনা ভয় ও আতঙ্ক আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ব্যবসায়ীরাও সরে যেতে চান
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বেনজিন, ইথাইল অ্যালকোহল, মিথাইল অ্যালকোহল ও হাইড্রোজেন পার-অক্সাইডের মতো অতি দাহ্য ২৯টি রাসায়নিক আমদানি ও মজুতের জন্য বিস্ফোরক অধিদপ্তরের অনুমোদন প্রয়োজন হয়। বেশিরভাগ বড় ব্যবসায়ী অনুমোদন নিয়ে সেগুলো সংরক্ষণ করলেও অনেক ছোট ব্যবসায়ী তা করেন না। আবার অনেকে গোপনে বিক্রিনিষিদ্ধ রাসায়নিকও বিক্রি করেন।
রাসায়নিক ব্যবসায়ীদের সংগঠন বাংলাদেশ কেমিক্যাল অ্যান্ড পারফিউমারি মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের উপদেষ্টা এনায়েত হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একটা সময়ে এই ব্যবসার সুনাম ছিল। কিন্তু দুটি বড় দুর্ঘটনার কারণে লোকজন এখন আমাদের ভালো চোখে দেখে না। আমরা এই দায় আর নিতে চাই না। এখান থেকে সরে যেতে চাই।’
এই ব্যবসায়ী নেতা ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘নিমতলীর আগুনের পর মুন্সিগঞ্জে রাসায়নিক শিল্পনগর করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সেটা এখনও বাস্তবায়ন হয়নি। আবার চুড়িহাট্টার দুর্ঘটনার পর অস্থায়ীভাবে গুদামগুলো সরিয়ে নিতে শ্যামপুর ও টঙ্গীতে জায়গা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এই কাজের অগ্রগতি সম্পর্কেও আমরা কিছু জানি না। সরকারের কেউ এ বিষয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা করেনি।’
ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে প্রয়োজনে অগ্রিম অর্থ নিয়ে হলেও অস্থায়ী গুদাম তৈরির কাজ এগিয়ে নেয়ার তাগিদ দেন এনায়েত।
পুরান ঢাকার বিদ্যমান অবস্থাকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ মনে করছেন বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল জিল্লুর রহমান। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় রাসায়নিকের যে পরিমাণ মজুত রয়েছে, তাতে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। যার ক্ষয়ক্ষতি হয়ত আগের দুর্ঘটনাগুলোকেও ছাপিয়ে যাবে।’
নিজেদের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়ে জিল্লুর রহমান বলেন, ‘আমরা বড়জোর জনসংযোগের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে পারি। সে কাজটিই এখন করে যাচ্ছি।’
অন্যদিকে দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এখনও রাসায়নিকের ব্যবসার ট্রেড লাইসেন্স দেয়া বন্ধ রেখেছে বলে জানান এর জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আবু নাছের। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বিষয়টি নিয়ে মেয়র মহোদয় ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এ ছাড়া শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে রাসায়নিকের গুদাম স্থানান্তর প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ করার তাগিদ দিয়েছেন।’