দিনাজপুরের ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ি। স্বাধীনতাযুদ্ধে সেনাবাহিনী, ইপিআর, পুলিশসহ জেলায় মুক্তিবাহিনীর প্রথম সমন্বিত ক্যাম্প ছিল এখানে। ক্যাম্পের খবর পেয়ে পরবর্তী সময়ে মর্টার শেল ছুড়ে জমিদারবাড়িটির অধিকাংশ মাটিতে মিশিয়ে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী।
স্বাধীনতার এত বছর পরও কালের সাক্ষী এই জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণে নেয়া হয়নি কোনো উদ্যোগ। এ সম্পর্কিত তথ্য জানারও নেই তেমন ব্যবস্থা।
দিনাজপুর সদর উপজেলায় ১০ থেকে ১২ বিঘা জমিতে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ি। পুরো এলাকা জুড়ে ছিল ছোট ছোট ভবন। পাকিস্তানি সেনাদের হামলায় এর প্রায় ৮০ শতাংশই ধ্বংস হয়।
স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা জানান, মুক্তিবাহিনীর সমন্বিত ক্যাম্পটিতে সদস্য ছিল দেড় হাজারেরও বেশি। পাশাপাশি হানাদার বাহিনীর ভয়ে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল জেলা শহরসহ বিভিন্ন স্থান থেকে আসা সাধারণ মানুষ।
ক্যাম্প স্থাপনের কিছুদিন পরই জানতে পেয়ে সেখানে মর্টার শেল আঘাতে তা ধ্বংস করে দেয় পাকিস্তান সেনাবাহিনী। তবে ওই সময় কতজন মারা যান তা জানাতে পারেননি কেউ।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মর্টার শেলের আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত কুয়া। ছবি: নিউজবাংলাস্থানীয়রা ক্ষোভ প্রকাশ করে জানান, স্বাধীনতার এত বছর পরও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এ জমিদারবাড়ির ধ্বংসাবশেষ রক্ষায় কোনো নেয়া হয়নি। এতে এক সময় ইতিহাস থেকে এটি হারিয়ে যাবে।
জমিদারবাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, পুরো এলাকা জুড়ে যত্রতত্র বাড়িঘর তুলেছেন জমিদার বংশের পরবর্তী প্রজন্ম। কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো ভবনগুলো অযত্ন-অবহেলায় যেন ভেঙে পড়ার দিন গুনছে।
ঘুঘুডাঙ্গা জমিদার বংশের আব্দুল মান্নান চৌধুরী নিউজবাংলাকে জানান, তিনি ওই জমিদার বংশের চতুর্থ প্রজন্ম। ১৯৭১ সালে তাদের বাড়িতে থেকে মুক্তিযোদ্ধারা সমন্বিতভাবে যুদ্ধ শুরু করে। ওই বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা দুই দিন ছিলেন। তাদের খাবারসহ সব সুযোগ সুবিধা দেয়া হয়।
তিনি বলেন, ‘দুই দিন পরই মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের জানালো, এখানে তাদের অবস্থানের ব্যাপারে পাকহানাদার বাহিনী জানতে পেরেছে। তাই এলাকাবাসী ও মুক্তিযোদ্ধাসহ সবাইকে এখান থেকে সরে যেতে হবে।
‘পরে তারাও চলে গেল, এপাশ থেকে আমরাও ভারতে চলে যাই। আমরা যাওয়ার পর পাকহানাদার বাহিনী এই জায়গা ধ্বংস করে দিয়েছিল। যুদ্ধের সময় মটার শেলের আঘাতে অসংখ্য বিল্ডিং ভেঙ্গে গেছে।’
যুদ্ধকালীন হামজাপুর ক্যাম্পের অপারেশন কমান্ডার লুৎফর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দিনাজপুর শহরে প্রথমে আমরা ১৭ দিন যুদ্ধ করি। পরে সৈয়দপুর থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী চলে আসলে আমরা দিনাজপুর শহর থেকে ঘুঘুডাঙ্গায় আসি। এখানে বাঙ্গালি, আর্মি, ইপিআর ও মুক্তিবাহিনীর প্রথম সমন্বিত ক্যাম্প গঠন করি।
‘ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারের বিশাল বাড়িতে আমরা আশ্রয় নিই। এখানে দুই দিন থাকার পর আমরা অন্য জায়গায় চলে যাই। পরবর্তীতে পাকহানাদার বাহিনী বাড়িটি মর্টার শেল দিয়ে ধ্বংস করে দেয়।’
মুক্তিযুদ্ধের সাক্ষী জমিদারবাড়িটি সংরক্ষণে সরকার ও অন্যান্য সংস্থার প্রতি আহ্বানও জানান তিনি।
অযত্ন-অবহেলায় ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ির একটি ভবন। ছবি: নিউজবাংলাদিনাজপুর সরকারি কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মাসুদুল হক নিউজবাংলাকে জানান, দিনাজপুরের মানুষের জন্য অন্যরকম নিদর্শন হচ্ছে ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ির প্রথম সমন্বিত ক্যাম্প। এই ক্যাম্প থেকে দিনাজপুর শহরকে শত্রুমুক্ত করার নানা পরিকল্পনা নেয়া হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী জানতে পেরে সেই ক্যাম্পে হামলা করে।
তিনি বলেন, জমিদারবাড়িটির ধ্বংসাবশেষ সংরক্ষণ করতে হবে। পাশাপাশি নতুন প্রজন্মের কাছে এই ক্যাম্পের ইতিহাস তুলে ধরতে মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখকদের এগিয়ে আসা উচিত।