মেয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছেন। মানতে না পেরে স্বামী ও তার পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে অপহরণ মামলা দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তা বাবা। মেয়ে আদালতে গিয়ে সব খুলে বলার পর মিলেছে জামিন। কিন্তু তাদের নামে একের পর এক মামলা হচ্ছেই।
মেয়ের শ্বশুরকে পেটানো হয়েছে হাতুড়ি দিয়ে। সরকারি কর্মকর্তা ভাসুরের ওপর হামলা হয়েছে। পরিবারটিকে বহন করা প্রাইভেট কারে হামলা হয়েছে।
ভুক্তভোগীরা বলছেন, হামলাকারীরা যাওয়ার সময় বারবার বলে যাচ্ছেন পুলিশ কর্মকর্তার নাম। কিন্তু তারা থানায় গিয়ে অভিযোগ করতে পারছেন না। ওই পুলিশ কর্মকর্তার নামে অভিযোগ নিতে চাইছে না থানা।
এই পরিস্থিতিতে প্রতিকার চেয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামালের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে পরিবারটি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় আল আমিন রাজীবকে মনে ধরে সামিয়া প্রেমার। ভালোলাগা থেকে ভালোবাসা। কিন্তু মানতে পারেননি বাবা ইনস্পেক্টর মীর শাহীন পারভেজ।
বাবার অমতে প্রাপ্তবয়স্ক দুই জন বিয়ে করেন। সেটা জানতে পেয়ে মেয়েকে বাসায় নজরবন্দি করেন। ভেঙে ফেলেন মেয়ের মুঠোফোন। বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী ও আত্মীয়দের সঙ্গেও যোগাযোগ বন্ধ করে দেন প্রেমার বাবা।
এভাবে কেটে যায় ৭-৮ মাস। কান্নাকাটি করেও বাবার মন গলাতে পারেননি প্রেমা। বরং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন সইতে হয় তাকে।
সুযোগ পেয়ে বাসা থেকে পালিয়ে স্বামীর বাড়িতে ঠাঁই নেন প্রেমা। রাজীব ও তার পুরো পরিবারের নামে পরদিনেই অপহরণ মামলা ঠুকে দেন বাবা।
ঘটনা ঘটেছে ঢাকার সাভারে। পাশের উপজেলা ধামরাইয়ের নিজ বাড়ি থেকে পালিয়ে প্রেমা উঠেছে আশুলিয়ার গকুলনগর স্বামীর বাড়িতে।
প্রেমার বাবা ঢাকা জেলা উত্তর (সাভার, আশুলিয়া ও ধামরাই থানা) এর গোয়েন্দা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্বপালন শেষে সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় ওসি হিসেবে যোগ দেন। সেখান থেকে প্রত্যাহার হয়ে বর্তমানে মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইনে কর্মরত।
মীর শাহীন পারভেজের বিরুদ্ধে তার আগের কর্মস্থলেও নানা অভিযোগ আছে।
সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়িত্ব পালনের সময় থানায় বসে জায়গা জমির মামলা মীমাংসার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। মাদক কারবারিদের কাছ থেকে সুবিধা নেয়া, গণপিটুনিতে বাক প্রতিবন্ধীর মৃত্যুর পর স্থানীয় কয়েকজন নিরপরাধ মানুষকে জড়িয়ে মামলা করার অভিযোগও ছিল। এসব ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তে প্রমাণ পাওয়ার পর তাকে নারায়ণগঞ্জ সদর থানায় বদলি করা হয়।
সেখানে জেলার সে সময়ের পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদের সঙ্গে অপেশাদারি আচরণের অভিযোগ ওঠার পর তাকে নারায়ণগঞ্জ পুলিশ লাইনে সংযুক্ত করা হয়। সেখান থেকে পাঠানো হয় মানিকগঞ্জে।
তার ভয়ে প্রেমা-রাজীব নিজের বাসা ছেড়ে ভাড়া বাসায় রয়েছেন।
রাজীবের পরিবারের সদস্যদের অভিযোগ, পুলিশের ভয়ে তারা অনেকটা বন্দিদশায় আতঙ্কে দিন পার করছেন।
প্রেমা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দেড় বছর আগে আমরা বিয়ে করেছি। আমার নিজের ইচ্ছায়। বাবাকে আমাদের সম্পর্কের কথা জানিয়েছিলাম। বাবা তারপর থেকে নানাভাবে প্রেসার, ওর ফ্যামিলিতে প্রেসার দেয়া হইছে। আমাকেও নানা ভাবে টর্চার করা হইছে।
‘অনার্স কমপ্লিট হওয়ার পরে আমাকে প্রায় এক বছর বাসায় আটকিয়ে রাখা হইছিল। কারো সাথে যোগাযোগ করতে দেয় নাই। ফোন ভেঙে ফেলছে। তারপরে গত ৩ নভেম্বর নিজে ইচ্ছায় আমার হাজব্যান্ডের কাছে পালায় আসি।
‘কিন্তু তারপর আমার হাজব্যান্ড, ভাসুর, শ্বশুর-শাশুড়ির নামে মামলা দেয়া হয়। পরে আমার ভাসুরকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। কোর্টে গিয়ে আমি নিজের জিম্মায় আমার হাজব্যান্ডের কাছে চলে আসি। আমার ভাসুরকেও জামিন দেয় আদালত।’
কী কারণে এমন করা হচ্ছে এমন প্রশ্নে প্রেমা বলেন, ‘আমার বাবা হচ্ছে ওসি। বাবা আশুলিয়া, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, সিদ্ধিরগঞ্জসহ বিভিন্ন থানায় ছিলেন। এখন মানিকগঞ্জ পুলিশ লাইনে আছে। হয়ত তার (বাবা) জিদটা বেশি কাজ করতেছে। মেয়ের সুখের চেয়ে বেশি। মেয়ের সুখটা দেখতেছে না।
‘এখন আমি নিজের ইচ্ছায় বিয়ে করছি, নিজের ইচ্ছায় আসছি, সংসার করতেছি একজনের সাথে। এখন তারপরও যদি সে (বাবা) আমাকে জোর করে নিতে চায় তাহলে সেটা তার (বাবা) ভুল। এখানে তো আর কারও কিছু করার নাই।’
অপহরণ মামলার ব্যাপারে এই তরুণী বলেন, ‘আমি বাসা থেকে যখন চলে আসছি তখন মামলা করা হইছে। কিন্তু আমার বাবা এটা জানত, আমি নিজের ইচ্ছায় আসছি। আমাকে অপহরণ করা হয়নি। তারপরও মামলা দিয়েছে। কোর্ট থেকে আসার পরে আমি আর বাবার সঙ্গে কনটাক্ট করি নাই। ফ্যামিলির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়নি। বাবা জানার পরও এমন একটা হ্যারাসমেন্ট করতেছে এই অভিমান, রাগ থেকেই কারও সঙ্গে যোগাযোগ করি নাই।’
আলামিন রাজীব বলেন, ‘বিয়ে করায় আমাকে নানা ভাবে থ্রেট দেয়া হয়। এমনকি আমার বাবাকে বিভিন্ন সময় থ্রেট দেয়া হচ্ছে। আমার ভাইয়ের উপর হামলা করা হয়েছে। তাই আমি প্রশাসনের কাছে অনুরোধ করছি, আমার পরিবারকে নিরাপত্তা দেয়া হোক। যাতে আমি সুখে শান্তিতে সংসার করতে পারি।’
রাজীবের বড় ভাই সরকারি পশু চিকিৎসক ওমর আলী নিউজবাংলাকে জানান, তার ওপর হামলা হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘গত ২২ নভেম্বর সকালে বাসা থেকে আমি ও আমার সহকারী মোটরসাইকেল নিয়ে চাকল গ্রামে যাচ্ছিলাম। তখন এই মোড়ে আসতেই তিনটা মোটরসাইকেল ও একটা প্রাইভেটকারে ৮-১০ জন আমার পথরোধ করার চেষ্টা করে। এ সময় তারা হাতুরি দিয়ে আঘাত করে ফেলে দেয়। পরে আমি ও আমার সহকারী দৌড়ে পালিয়ে যাই। আর আশপাশের লোকজন এগিয়ে আসলে সন্ত্রাসীরা দ্রুত চলে যায়।’
হামলার ঘটনা ঘটেছে রাজীবের বাবার ওপরওরাজীবের চাচাতো ভাই আসিফ মাহমুদ জানান, হামলা হয়েছে রাজীবের বাবার ওপরও। সিন্দুরিয়া এলাকার ফার্মেসি বন্ধ করে বাসায় ফেরার সময় দুটি মোটরসাইকেলে চারজন দুর্বৃত্ত এসে হামলা চালায়। তারা রাজীবের বাবার মাথায় হাতুরি দিয়ে আঘাত করে।
“চাচার চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে আসলে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। তবে যাওয়ার সময় আঘাতকারীরা আমার চাচাকে বলে ‘শাহিন পারভেজের মনের আশা পূর্ণ করলাম’।”-বলেন আসিফ মাহমুদ।
গত ৯ ডিসেম্বর আদালতে হাজিরা দিয়ে বাসায় ফেরার পথে প্রেমা, রাজীব ও তাদের বাবা রসুল হককে বহন করা প্রাইভেটকারে হামলা হয় উলাইল স্ট্যান্ডের কিছুটা আগে। ১৫ থেকে ২০ জন লাঠিসোটা নিয়ে গাড়ি আটকায়। তারা প্রেমাকে টেনে গাড়ি থেকে নামানোর চেষ্টা করে।
পেছন থেকে আসা আরেকটা গাড়িতে সাংবাদিকরা সেখানে উপস্থিত হলে পালিয়ে যায় হামলাকারীরা।
আসিফ জানান, হামলার ঘটনায় তারা থানায় অভিযোগ করতে যান। কিন্তু সন্দেহভাজন হিসেবে ওসি শাহীন পারভেজের নাম শোনার পর অভিযোগে লিখতে রাজি হয়নি আশুলিয়া থানার পুলিশ কর্মকর্তা।
অভিযোগ নিয়ে প্রেমার বাবা শাহীন শাহ পারভেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘মামলা দিব না? তুমি (মেয়েকে বুঝিয়েছেন) কোথায় গেছ আমি জানব ক্যামনে? মামলা দিছি বিধায় তো জানতে পারছি তুমি কোথায় আছো।’
প্রেমার বাবা পুলিশ ইনস্পেক্টর মীর শাহীন পারভেজপ্রেমাকে মারধরের কথাও স্বীকার করেন ওসি। তবে মেয়ের শ্বশুর বাড়ির লোকজনের উপর হামলার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, এসব কারা করছে, তা তিনি জানেন না।
জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এসএম কামরুজ্জামান বলেন, ‘বৃদ্ধকে হাতুরিপেটা করার ঘটনায় অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অভিযোগে একজন পুলিশ কর্মকর্তার নামও রয়েছে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগীরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও অভিযোগ করেছেন। আমরা বিষয়টি তদন্ত করে দেখছি।’
ওসির পরিবার থেকে করা অপহরণ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ধামরাই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘অপরহণ মামলায় রাজীবসহ তার পরিবারের আরও চার সদস্য আসামি। মামলার পরদিন রাজীবের ভাই ওমর ফারুককে গ্রেফতার করা হয়। তবে আসামিরা সবাই জামিনে আছেন। আদালতে ওসি শাহীন পারভেজের মেয়ে হাজির হয়ে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। বিষয়টা সম্পূর্ণ আদালতের। তবে সুষ্ঠু তদন্ত করে মামলার চার্জশিট দেয়া হবে।’