সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (শাবিপ্রবি) মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য স্থাপনের উদ্যোগ নেয়া হয় ২০১৩ সালে। বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে ‘মুক্তিযোদ্ধা সন্তান ও মা’ এর ভাস্কর্য স্থাপনের জন্য ভিত্তিও নির্মাণ করা হয়।তবে ভাস্কর্য স্থাপনের বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার’ অভিযোগ এনে প্রতিবাদে মাঠে নামে উগ্রবাদী গোষ্ঠী। তাদের সঙ্গে যোগ দেয় বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তি। এদের প্রতিবাদের মুখে আটকে যায় ভাস্কর্য স্থাপন। সাত বছরেও এই ভাস্কর্য আর হয়নি।
বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন গোষ্ঠীর আপত্তি এবং এ নিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভের মুখে শাবিপ্রবির আটকে থাকা মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের বিষয়টি আবার আলোচনায় এসেছে। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য ইস্যুতে সরকার ‘ইতিবাচক মনোভাব’ প্রকাশ করায় শাবিপ্রবি’র ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ পুনরায় শুরুর দাবি জানিয়েছেন শিক্ষকরা।
উগ্রবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতার কারণে নানা সময়েই আলোচনায় উঠে এসেছে সিলেটের কুমারগাও এলাকায় গড়ে ওঠা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার এই বিদ্যাপীঠ। এর আগে ১৯৯৯ সালে শাবিপ্রবির ছাত্র হল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে ও ছাত্রী হল শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নামে করার সিদ্ধান্ত নেয় সিন্ডিকেট। এমন সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মাঠে নামে জামায়াত-শিবিরসহ ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক গোষ্ঠী।সিলেটজুড়েই আন্দোলন গড়ে তোলে তারা। ওই আন্দোলনে আবদুল মুনিম বেলাল নামে শিবিরের এক কর্মী বিজিবির (তৎকালীন বিডিআর) গুলিতে নিহত হন। সে সময় নামকরণের পক্ষে জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ, প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ বিশিষ্টজনেরা শাবিপ্রবির ফটকে অনশন করেন। যা দেশজুড়েই বেশ আলোচনার জন্ম দেয়। তবে ধর্মভিত্তিক গোষ্ঠীর আন্দোলনের মুখে শেষ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু ও জাহানারা ইমামের নামে নামকরণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে শাবিপ্রবি প্রশাসন।২০০০ সালের ৬মে ৮৯তম সিন্ডিকেট সভায় হলের নামকরণে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি স্থগিতাদেশ জারি করেন। বিভিন্ন সময় জঙ্গিগোষ্ঠীর তৎপরতাও আলোচনায় এসেছে এই বিশ্ববিদ্যালয়। ২০১৮ সালের ২ মার্চ ক্যাম্পাসের ভেতরেই শিক্ষক, জনপ্রিয় লেখক অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে ছুরিকাঘাত করে এক তরুণ। আটকের পর পুলিশ জানিয়েছিল ‘ইউটিউবে ওয়াজ শুনে বিপথগামী হয়েছিলেন’ সেই তরুণ।
২০১৩ সালের জানুয়ারিতে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালকে আহ্বায়ক করেই ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণে কমিটি গঠন করা হয়। ওই কমিটির অন্য সদস্যরা ছিলেন- অধ্যাপক ড. ইউনুস, অধ্যাপক ড. রাশেদ তালুকদার, অধ্যাপক সুশান্ত কুমার দাস, অধ্যাপক সৈয়দ হাসানুজ্জামান শ্যামল ও অধ্যাপক মস্তাবুর রহমান।
কমিটির আহ্বায়ক মুহম্মদ জাফর ইকবাল গত বছর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নিয়েছেন। এই কমিটির সদস্য অধ্যাপক ড. ইউনুস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘একজন মা তার সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে পাঠানোর সময় মাথায় হাত বুলিয়ে আশীর্বাদ করছেন’- এমন থিমে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হচ্ছিল। ভাস্কর্যটির নকশা চূড়ান্ত করে নির্মাণ কাজও শুরু হয়েছিল। ৪৫ ফুট উচ্চতার ওই ভাস্কর্যটি নির্মিত হলে এটি হতো দেশের সর্বোচ্চ ভাস্কর্য।
তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ শুরুর পর প্রথমে ক্যাম্পাসের ভেতরের ডানপন্থি গোষ্ঠী এর বিরোধিতা শুরু করে। এরপর শহরের ডানপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোও তাদের সঙ্গে যোগ দেয়। শহরে ও ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বিক্ষোভ কর্মসূচি পালনের পাশপাশি তারা সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে ভাস্কর্য নির্মাণ বন্ধে স্মারকলিপি দেয়।’
এই গোষ্ঠীর তৎপরতা বন্ধে স্থানীয় প্রগতিশীল রাজনৈতিক গোষ্ঠী তেমন তৎপর ছিল না উল্লেখ করে তিনি বলেন, একপর্যায়ে সরকারের উচ্চমহল থেকে ভাস্কর্য নির্মাণ কাজ বন্ধের নির্দেশনা আসে। এরপর আটকে যায় কাজ।
ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চত্বরের পাশে গোলচত্বর হিসেবে পরিচিত জায়গায় ভাস্কর্যের জন্য নির্মিত ইট সিমেন্টের ভিত্তি এখনও রয়ে গেছে। দীর্ঘদিন অযত্নে পড়ে থাকার পর সমাবর্তন উপলক্ষে গত বছর এই জায়গার কিছুটা সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়। তবে ভাস্কর্যের জায়গা এখনও ফাঁকা রয়ে গেছে।
তবে এই স্থানে ভাস্কর্য নির্মাণ সম্ভব না হলেও ক্যাম্পাসের একটু ভেতরেই ‘চেতনা ৭১’ নামে একটি ভাস্কর্য রয়েছে শাবিপ্রবিতে। ২০১২ সালে নির্মিত এই ভাস্কর্য নিয়ে কোনো আপত্তি আসেনি।
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাবের সভাপতি হোসাইন ইমরান বলেন, ‘সব বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভাস্কর্য আছে। কিন্তু আমাদের এখানে নেই। এখানে কিছু করতে গেলেই মৌলবাদী গোষ্ঠী আপত্তি জানায়। জঙ্গিরা এই ক্যাম্পাসে আস্তানা গড়ে। এসব ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও কঠোর হতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস হবে মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তমত চর্চার কেন্দ্র।’
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘আমি এখানে যোগ দেয়ার আগেই গোলচত্বরের ওই ভাস্কর্য নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে মৌলবাদী গোষ্ঠী মাঠে নেমেছিল। পরে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবাই এর বিরোধিতা করে। কারণ কারও সঙ্গে আলোচনা না করেই ভাস্কর্যটির নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছিল। সবার সঙ্গে কথা বলে কাজ করলে হয়তো এই সমস্যা হতো না। পরে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় তখনকার অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ আসনের সংসদ সদস্য আবুল মাল আবদুল মুহিত ভাস্কর্যের কাজ বন্ধ রাখতে বলেন। এখন এই কাজ আবার শুরু করতে হলে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘যারা এখন ভাস্কর্যের বিরোধিতা করছে তারা স্বাধীনতা বিরোধী চক্র। এরা একাত্তরেও ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট করেছে। বাংলাদেশকে এদের থেকে মুক্ত রাখতে হবে।’
ভাস্কর্য হলো সৌন্দর্য। এর সঙ্গে ধর্মের কোনো যোগ নেই। আমিও চাই আমাদের ক্যাম্পাসে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মিত হোক। তবে আমার মেয়াদ প্রায় শেষ হয়ে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় এখন খুব সন্দরভাবে চলছে। তাই শেষ সময়ে এসে আমি কোনো ঝামেলায় জড়াতে চাই না। এ বিষয়ে তাই সবার সঙ্গে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’
তবে শাবিপ্রবির ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ শিক্ষকবৃন্দ’ এর আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুল গনি বলেন, এই ক্যাম্পাসে, সিলেট শহরে যেসব স্বাধীনতা বিরোধীরা ভাস্কর্যের বিরোধিতা করেছিল, তারা ও তাদের দোসররাই আজ জাতীয়ভাবে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদেরকে রুখে দিতে হবে। সরকার থেকে এরই মধ্যে এই গোষ্ঠীর প্রতি কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। ভাস্কর্য ইস্যুতে সরকার তাদের মনোভাব স্পষ্ট করেছে। তাই এখনই আমাদের ক্যাম্পাসের অসমাপ্ত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্যের কাজ সমাপ্ত করার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।’