পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যান বসানো, অগ্রগতির খবরে সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে চোখ রাখেন প্রকৌশলী কারিশমা ফারহীন চৌধুরী। এই প্রকল্পটির সঙ্গে নিজে কোনোভাবে জড়িত না থাকলেও তার আত্মিক যোগাযোগ আছে।
এই প্রকৌশলী বাংলাদেশের প্রখ্যাত প্রকৌশলী জামিলুর রেজা চৌধুরীর মেয়ে যিনি ছিলেন দেশের সবচেয়ে বড় এই অবকাঠামো প্রকল্পের পরামর্শক কমিটির প্রধান।
চলতি বছরের ২০ এপ্রিল ৭৭ বছর বয়সে মারা যান বাংলাদেশের অগ্রগণ্য এই প্রকৌশলী। ফারহীন দেখেছেন, এই প্রকল্পটির জন্য তার বাবার আকুতি।
জামিলুরের ভাবনা নিয়ে জানতে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় তার যুক্তরাজ্য প্রবাসী মেয়ের সঙ্গে।
ভিডিও সাক্ষাৎকারে ফারহীন জানিয়েছেন প্রকল্প ঘিরে বাবার আবেগ, উদ্দীপনা, চ্যালেঞ্জ, উদ্বেগ, গর্ব আর স্বপ্নের কথা; যা তাদের পুরো পরিবারকেই সব সময় এক ধরনের উত্তেজনার মধ্যে রাখত। তাই তার মৃত্যুর পরেও তাদের মনোযোগ রয়ে গেছে সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দিকে।
প্রকল্প শুরুর দিকে জামিলুর রেজা চৌধুরীর প্রতিক্রিয়া কেমন ছিল?
পদ্মা সেতুর এখন পুরোটাই দৃশ্যমান। এখন ওপরে সড়ক আর ভেতরে রেল লাইনের কাজ চলছেকারিশমা ফারহীন চৌধুরী বলেন, ‘বাবাও প্রথম থেকে দেশের সবার মতোই এই প্রজেক্টটি নিয়ে খুবই এক্সসাইটেড ছিলেন। এর পেছনে অনেকগুলো কারণ ছিল। প্রথমত তিনি জানতেন- এটি দেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্প।
‘দ্বিতীয়ত প্রকৌশলী হিসেবে এটা উনার জন্য অনেক চ্যালেঞ্জিং একটি প্রজেক্ট ছিল। অনেকেই জানেন, এই প্রকল্পে অনেকগুলো সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বাধা ছিল। নদী শাসন, মাটির শক্তিমাত্রাসহ আরও অনেকগুলো বিষয়।’
বাংলাদেশের বড় বড় সব প্রকল্প বিদেশি অর্থায়নে হতো বলে সহযোগী দেশগুলোর অনেক শর্ত মেনে কাজ করতে হতো। পরামর্শদাতা হিসেবে বিদেশিদেরই নিয়োগ দেয়ার শর্ত থাকত।
এ নিয়ে জামিলুর রেজা চৌধুরীর সবসময় ক্ষুব্ধ ছিলেন।
কারিশমা ফারহীন চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশি যাদেরকে পরামর্শদাতা হিসেবে নিয়োগ দেয়া হতো, দেখা যেত কিছু ক্ষেত্রে তাদের কারিগরি দক্ষতাও আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের চেয়ে কম। কিন্তু অর্থের জন্য আমরা অন্যদের উপর নির্ভর থাকতাম বলে কিছু করা যেত না।
‘পদ্মা সেতু যেহেতু নিজস্ব অর্থায়নে হচ্ছিল, ফলে আমাদের সেরা প্রকৌশলীদের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করার একটা সুযোগ সৃষ্টি হয়েছিল। জামিলুর রেজা চৌধুরীর পাশাপাশি অনেক প্রবাসী বাংলাদেশি প্রকৌশলীও বিভিন্ন ধাপে এই কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।’
এই প্রকল্পটিতে শেষ পর্যন্ত জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আর ক্ষুব্ধ থাকতে হয়নি। কারণ, বিশ্বব্যাংকের টালবাহানা শেষে সরকার পরে নিজ অর্থে সেতুর কাজ শুরু করে। তখন আর আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাটির কোনো খবরদারি ছিল না।
বাবার সঙ্গে প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখার স্মৃতি স্মরণ করে কারিশমা ফারহীন চৌধুরী বলেন, ‘আমার সৌভাগ্য হয়েছিল গত জানুয়ারি মাসে বাবাসহ পদ্মা সেতু স্বচক্ষে দেখতে যাওয়ার। আমরা পুরো পরিবারের সবাই পদ্মা সেতুর অগ্রগতি দেখতে গিয়েছিলাম। তখন মনে হয় ২৯ বা ৩০টির মতো স্প্যান বসেছিল। তখন আমরা বুঝতে পারছিলাম তিনি কতটা গর্ববোধ করছেন।’
পদ্মা সেতু নিয়ে দুর্নীতির চেষ্টার যে অভিযোগ উঠেছিল সে সময় জামিলুর রেজা চৌধুরীর মনের অবস্থা কেমন ছিল, তিনি শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলেন কি না- তা নিয়েও কথা বলেছেন তার মেয়ে।
কারিশমা ফারহীন চৌধুরী বলেন, ‘বাবা আসলে কাজের জায়গাগুলো নিয়ে খুবই গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগের সময় প্রকল্প নিয়ে আমাদের সঙ্গে খুব বেশি খোলামেলা আলোচনায় যেতেন না। তবে সে সময় বাবাকে বেশ উদ্বিগ্ন দেখা যেত।’
তবে জামিলুর রেজা চৌধুরী সবসময়ই আশাবাদী ছিলেন বলে জানান তার মেয়ে। কারিশমা ফারহীন চৌধুরী বলেন, ‘বাবা সরকারকেও এটা বুঝাতে পেরেছিলেন আমাদের পক্ষেই এই সেতু তৈরি করে ফেলা সম্ভব।’