সব অনিশ্চয়তা কাটিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে পদ্মা সেতু। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাহসী নেতৃত্বের কারণেই তা সম্ভব হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বৃহস্পতিবার জয়পুরহাট জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে এ কথা বলেন তিনি।
ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘বিশ্বকে অবাক করে দিয়ে নিজস্ব অর্থায়নে ছয় দশমিক এক পাঁচ কিলোমিটার দীর্ঘ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর সর্বশেষ স্প্যান আজ বসানো হয়েছে।
‘বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বে শত বাধা অতিক্রম করে পদ্মা সেতু আজ দৃশ্যমান। তার মানবিক ও সাহসী নেতৃত্বের কারণেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করে বাংলাদেশ আজ বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে আমরাও পারি।’
বৃহস্পতিবার সকালে পদ্মাসেতুতে বসানো হয় ৪১তম তথা সবশেষ স্প্যান। এতে সেতুর মুল কাঠামো ছয় দশমিক ১৫ কিলোমিটারের পুরোটাই দৃশ্যমান হয়।
এই সেতু নির্মাণের পথে কত বাধাই না মোকাবিলা করতে হয়েছে বাংলাদেশকে। সবকিছুই মিছে প্রমাণ করল সরকার।
২০০৯ সালের শুরুতে সরকার গঠনের পর শুরু হয় সেতু তৈরির প্রাথমিক পরিকল্পনা। কিন্তু হঠাৎ পিছু হটতে থাকে দাতা সংস্থাগুলো।
২০১০ সালে প্রিকোয়ালিফিকেশন দরপত্র আহ্বান করা হয়। পদ্মা সেতুতে অর্থায়নে আগ্রহ দেখায় বিশ্বব্যাংক। সেই সঙ্গে সহযোগী হতে চায় এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিপি), ইসলামী উন্নয়ন ব্যাংক (আইডিবি) ও জাইকা।
২০১১ সালের ২৮ এপ্রিল সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি হয়। পদ্মা নদীতে ‘ভাষা শহীদ বরকত’ নামের ফেরিতে এই চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষে সই করেন অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া আর বিশ্বব্যাংকের পক্ষে বাংলাদেশে সংস্থাটির আবাসিক প্রতিনিধি অ্যালেন গোল্ডস্টাইন।
পদ্মা সেতু নির্মাণ চুক্তিতে সই করছেন বিশ্বব্যাংক ও বাংলাদেশের প্রতিনিধি। ফাইল ছবি
একই প্রকল্পে ২০১১ সালের ১৮ মে জাইকার সঙ্গে, ২৪ মে আইডিবির সঙ্গে এবং ৬ জুন এডিবির সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। এডিবি ৬১ কোটি, জাইকা ৪০ কোটি ও আইডিবি ১৪ কোটি ডলার দেবে বলে ঠিক হয়।
কিন্তু বিশ্বব্যাংক উড়ো কথার ভিত্তিতে পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ তোলার পর শুরু হয় টানাপোড়েন। সংস্থাটির অভিযোগ ছিল, কানাডার প্রতিষ্ঠান এসএনসি লাভালিন কাজ পেতে বাংলাদেশের কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে ঘুষ দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে।
সরকার শুরু থেকেই এই অভিযোগ নাকচ করলেও চাপ অব্যাহত থাকে বিশ্বব্যাংকের। এক পর্যায়ে ২০১১ সালে ঋণচুক্তি স্থগিত করে।
আকাশ থেকে পদ্মা সেতুর ছবি তুলছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবি
পরে যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়াকে প্রধান আসামি করে সাত জনের বিরুদ্ধে মামলা করে দুর্নীতি দমন কমিশন। কিন্তু বিশ্বব্যাংক চাপ দিতে থাক সে সময়ের যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনকে আসামি করতে।
সরকার রাজি না হওয়ার পর ২০১২ সালের ৩০ জুলাই ঋণচুক্তি বাতিল করে বিশ্বব্যাংক। এই নিয়ে টানা পোড়েনে বিশ্বব্যাংক প্রকল্পটি থেকে সরে যাওয়ার পর সরে যায় এডিবি, জাইকা ও আইডিবিও।
কিন্তু হাল ছাড়েনি সরকার। ২০১২ সালের ১০ জুলাই নিজ অর্থে সেতু নির্মাণের বিষয়ে প্রথম কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেদিন তিনি বলেন, নিজ অর্থায়নে সেতু নির্মাণের ব্যাপারে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে ব্যাপক সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।
২০১৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি সংসদে সরকারপ্রধানের ঘোষণার পর নিশ্চিত হয়ে যায়, দাতাদের চ্যালেঞ্জ করেই এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জের মাওয়ায় পদ্মা সেতুর মূল পাইলিং কাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল কাজ উদ্বোধন করেন তিনি।
সেদিন জনসভায় বিশ্বব্যাংকের টালবাহানা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘হঠাৎ কোনো কারণ ছাড়াই বিশ্ব ব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ আনে।…আমি বলি, দুর্নীতির প্রমাণ দিতে হবে। কারণ তখনও টাকা ছাড় হয়নি। আজ পর্যন্ত তারা প্রমাণ করতে পারে নাই যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি চেয়েছিলাম, আমরা পারি, আমরা তা দেখাব।… আজ আমরা সেই দিনটিতে এসে পৌঁছেছি।’
নানা নাটকীয়তা শেষে নিজ অর্থে সেতুর কাজ শুরু হয় ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে।
সেতু তৈরির কাজ পায় চায়না মেজর ব্রিজ নামে একটি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি সিনো হাইড্রো করপোরেশনকে দেয়া হয় নদী শাসনের কাজ। দেশীয় প্রতিষ্ঠান আবদুল মোনেম দুই প্রান্তে ১৪ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বুয়েট নির্মাণ কাজ তদারক করছে।
২০১৪ সালের জুলাইয়ের মধ্যে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান যন্ত্রপাতি আনা শুরু করে। ২০১৪ সালের ৭ ডিসেম্বরে সেতু প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। যদিও মূল সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধন হয় ২০১৫ সালের ১২ ডিসেম্বর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
সেতুর পূর্ণাঙ্গ রূপ পাওয়ার দিন মুন্সিগঞ্জের মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অগ্রগতি দেখতি গিয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ‘পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা সকল ষড়যন্ত্রের জবাব দিয়েছেন।
‘সমস্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে বিশ্বে বাংলাদেশকে মর্যাদার আসনে বসিয়েছেন। সমগ্র বিশ্বর কাছে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। পদ্মা সেতু নির্মাণের মাধ্যমে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ টি জেলাকে সরাসরি সড়ক নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসছেন প্রধানমন্ত্রী।’
আকাশ থেকে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ দেখছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ফাইল ছবিদেশের দীর্ঘতম এ বহুমুখী সেতুর মূল আকৃতি হবে দোতলা। কংক্রিট ও স্টিল দিয়ে নির্মিত পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন; উপর দিয়ে চলবে অন্যান্য যানবাহন।
শুরুতে এই মহাপ্রকল্পের নির্মাণের ব্যয় ধরা হয় ১০ হাজার কোটি টাকারও বেশি। তবে তিন ধাপে বাড়ানো হয় প্রকল্প ব্যয়। শেষ পর্যন্ত ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার কোটি টাকারও বেশি।