নদী দখল করে সংসদ সদস্য আসলামুল হকের মালিকানাধীন মায়িশা গ্রুপ ও আরিশা ইকোনমিক জোন উচ্ছেদ বন্ধ এবং ক্ষতিপূরণ চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিয়েছে হাইকোর্ট।
বিচারপতি মো. আশফাকুল ইসলাম ও বিচারপতি মোহাম্মদ আলীর হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার আসলামের রিট খারিজের আদেশ দেয়।
আদালতে এমপি আসলামের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী অজি উল্লাহ ও আইনজীবী মামুন মাহবুব, নদী কমিশনের পক্ষে ছিলেন আইনজীবী মনজিল মোরসেদ।
মনজিল মোরসেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমপি আসলামের প্রতিষ্ঠান উচ্ছেদ বন্ধ চেয়ে করা রিট খারিজ করে দিয়েছে আদালত। এর ফলে তার দখল উচ্ছেদে আর কোনো বাধা রইল না।’
বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করার অভিযানের অংশ হিসেবে গত ৩ মার্চ মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্টের সীমানা প্রাচীরসহ বেশকিছু স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেয় বিআইডাব্লিউটিএ। উদ্ধার করা হয় প্রায় চার একর জমি। এই প্ল্যান্টের পাশেই রয়েছে আরিশা বেসরকারি ইকোনমিক জোন।
বিআইডব্লিউটিএর অভিযানের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে তিনটি রিট করেন এমপি আসলামুল হক। এর মধ্যে একটির শুনানি নিয়ে আদালত বিরোধপূর্ণ ভূমিতে জরিপ চালিয়ে প্রতিবেদন দিতে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে নির্দেশ দেয়।
এরপর ১৬ সেপ্টেম্বর নদী রক্ষা কমিশনের সম্মেলন কক্ষে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের উপস্থিতিতে শুনানি হয়। পাশাপাশি বিরোধপূর্ণ জায়গায় জেলা প্রশাসন, বিআইডাব্লিউটিএ, বাংলাদেশ মহাকাশ গবেষণা ও দূর অনুধাবন প্রতিষ্ঠানের (স্পারসো) মতো আটটি সরকারি সংস্থা জরিপ চালায়।
এসবের ভিত্তিতে নদী রক্ষা কমিশনের তৈরি চূড়ান্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, এমপি আসলামের বিরুদ্ধে নদীর জায়গা দখলের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে।
- আরও পড়ুন: নদী দখলের অভিযোগ: এমপি আসলামের সাফাই
প্রতিবেদনে বলা হয়, নদীর প্লাবন ভূমির শ্রেণি পরিবর্তন করে মায়িশা গ্রুপ ও আরিশা ইকোনমিক জোনের কার্যক্রম প্রাকৃতিক জলাধার আইন ২০০০ এর ৫ ধারার বিধানের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। ইকোনমিক জোনটি পূর্ণাঙ্গভাবে বাস্তবায়িত হলে বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের জীববৈচিত্র্যের ওপর বিরূপ প্রভাব আরও প্রকট হবে। তাই বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ রক্ষার স্বার্থে আরিশা বেসরকারি ইকোনমিক জোন ও মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্টের কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।
বুড়িগঙ্গা নদীর ৫৪.০১৭৮ একর প্লাবনভূমিতে আরিশা বেসরকারি ইকোনমিক জোন ও মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্টের অবস্থানের বিষয়টি ‘প্রমাণিত সত্য’ উল্লেখ করে কমিশন বলেছে, এটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আসলামের দখলের কারণে মরে গেছে নদীর ১৪ কিলোমিটার এলাকা।
আরিশা বেসরকারি ইকোনমিক জোন ও মায়িশা পাওয়ার প্ল্যান্টকে পরিবেশ অধিদপ্তরের দেয়া ছাড়পত্র আইনের পরিপন্থী বলেও মন্তব্য করে কমিশন। প্রতিবেদনে বলা হয়, এ দুটি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে লাল শ্রেণিভুক্ত করে ছাড়পত্র নবায়ন করা হয়েছে। নদীর জমি জেনেও অবস্থানগত, ইআইএ, পরিবেশগত ছাড়পত্র দেয়া যুক্তিসঙ্গত হয়নি।
প্রতিবেদনে দ্রুত এসব স্থাপনা উচ্ছেদ করতে বিআইডব্লিউটিএ এবং জেলা প্রশাসনকে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়। এমপি আসলাম অবৈধ স্থাপনা নিজ উদ্যোগে অপসারণ না করলে উচ্ছেদের সম্পূর্ণ খরচ তাকে দিতে হবে বলেও উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
ঢাকা শহরের চারপাশের চার নদী দূষণ ও দখল মুক্ত করতে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে রিট করে হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ নামে একটি সংগঠন।
ওই রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে নদী রক্ষায় ৯ দফা নির্দেশনা দিয়ে রায় দেয় হাইকোর্ট। তার মধ্যে একটি ছিল সিএস জরিপ ম্যাপ অনুসারে নদীগুলোর সীমানা জরিপ সম্পন্ন করে নদীর দুই পাশে সীমানা পিলার স্থাপন। একই সঙ্গে নদীর অভ্যন্তরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করতে হবে।
আদালতের এ নির্দেশনার আলোকে বিআইডব্লিউটিএ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা শুরু করে। কিন্তু তাদের উচ্ছেদ অভিযান চ্যালেঞ্জ করে এমপি আসলামের মালীকানাধীন মায়িশা গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান সিএলসি, ঢাকা ওয়েস্ট পাওয়ার, ঢাকা নর্থ পাওয়ারের পক্ষ থেকে একটি রিট করা হয়।
রিটে উচ্ছেদ অভিযান বন্ধ এবং ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়। ওই রিটের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ অক্টোবর হাইকোর্ট নদী কমিশনকে তাদের করা আবেদন ৩০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তির নির্দেশ দেয়। পরে নদী কমিশন বিষয়টি তদন্ত করে গত ৯ নভেম্বর রিপোর্ট দাখিল করে।
নদী কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, মায়িশা গ্রুপের তিনটি প্রতিষ্ঠান নদীর ১২.৭৮ একর এবং ফোরশোর ৭.৯২ জায়গা দখল করেছে। এমনকি রাজউকের ড্যাপে প্রদর্শিত ৩০ একরের মতো জায়গায় মাটি ভরাট করে জলাশয় ও নদীর প্রবাহে বাধা দেয়া হয়েছে।
নদী কমিশনের এই রিপোর্ট সংযুক্ত করে ৩০ নভেম্বর আদালতে একটা আবেদন দাখিল করা হয়। আদালত ওই আবেদনের শুনানি শেষে আজ রিটটি খারিজ করে দেয়।