মা ও চাচির সঙ্গে বাজারে যাওয়ার আগে জুতা কেনার জন্য দাদির কাছে ১০০ টাকা চেয়েছিল দুই বছরের মারিয়া।
দাদি টাকা দেয়ার পর বলেছিল, বড় হয়ে টাকাটা ফেরত দেবে সে। কিন্তু সে কথা আর রাখতে পারবে না মারিয়া। কারণ বড় হওয়ার আগেই নিয়ন্ত্রণহীন বাস কেড়ে নিয়েছে তার প্রাণ।
সোমবার বিকেলে হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে বিআরটিসির বাসচাপায় নিহত আট জনের এক জন ছোট্ট মারিয়া। দুর্ঘটনায় তার মা ছমিরুল বেগম (২৮) ও চাচি হালিমা বেগমও (২৫) নিহত হন।
মুড়াউড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, মারিয়াদের বাড়ি যেন ‘শ্মশানপুরী’। নবীগঞ্জ উপজেলার গ্রামটিও শোকে স্তব্ধ।
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, মারিয়ার দাদা বৃদ্ধ আব্দুল আহাদ ও দাদি রাবেয়া বানু বসে কাঁদছেন। অশ্রুসিক্ত চোখে মারিয়া কী বলে ১০০ টাকা নিয়ে ছিল, তা জানান দাদি রাবেয়া।
তিনি জানান, সোমবার বিকেলে দুই পুত্রবধূ নাতনি মারিয়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে অটোরিকশায় পানিউমদা বাজারের উদ্দেশে রওনা হন। সেই সময়ই তার কাছে টাকা চায় মারিয়া।
রাবেয়া আরও জানান, মারিয়ারা বের হওয়ার ঘণ্টাখানেক পরই তারা দুর্ঘটনার খবর পান। সঙ্গে সঙ্গে অটোরিকশা নিয়ে বড় ছেলে আবু তাহেরের সঙ্গে ঘটনাস্থলে ছুটে যান। সেখানে স্ত্রী-সন্তানকে বাসের নিচে চাপা পড়ে থাকতে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে তার ছেলে তাহের।
এখনও মায়ের অপেক্ষায় শিশু লামিয়া
বৃদ্ধ দাদা-দাদির এখন বড় দুশ্চিন্তা মারিয়ার বড় বোন চার বছরের লামিয়াকে নিয়ে। সে এখনও জানে না, তার মা আর ফিরবে না। শিশুটি এখনও ভাবছে ছোট বোনকে নিয়ে মা বাজারে গেছে; ফেরার সময় ‘মজা’ (খাবার) নিয়ে আসবে।
দাদির কোলে চার বছরের শিশু লামিয়া। ছবি: নিউজবাংলা
বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিবেশী শিশুদের সঙ্গে খেলছে লামিয়া। তবে মাঝে মাঝে এসে দাদিকে জিজ্ঞেস করছে ‘মা কখন ফিরবে’। আবার মা ফিরতে দেরি করছে দেখে মাঝে মাঝে কাঁদছে সে।
দাদা আব্দুল আহাদ জানান, লামিয়ার বাবা কাজের জন্য সারাদিন বাইরে থাকেন। মাকে না দেখে কান্না করছে লামিয়া। মা ছাড়া এই অবুঝ শিশুকে কীভাবে রাখবেন তারা বুঝে উঠতে পারছেন না।
তিনি বলেন, ‘মেয়ে দুটিকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন ছিল তাদের মা-বাবার। মেয়েদের লেখাপড়া করিয়ে মানুষ করতে চেয়েছিল। অভাবের সংসার হলেও মেয়েদের কখনও তারা অভাব বুঝতে দেয়নি।’
দুর্ঘটনার বিষয়ে প্রত্যক্ষদর্শীর বরাত দিয়ে পুলিশ জানিয়েছিল, সোমবার কুমিল্লা থেকে সিলেটগামী বিআরটিসির একটি বাস নবীগঞ্জের সাতহাইল এলাকায় পৌঁছানোর পর নিয়ন্ত্রণ হারায়। এ সময় বিপরীত দিক থেকে আসা দুটি অটোরিকশা ও একটি মোটরসাইকেলকে চাপা দেয় বাসটি।
গাড়িগুলোকে টেনে নিয়ে বাসটি খাদে পড়ে যায়। অটোরিকশা দুটি ওই বাসের নিচেই চাপা পড়ে।
খবর পেয়ে নবীগঞ্জ থানা, শেরপুর হাইওয়ে, গোপলার বাজার তদন্ত কেন্দ্রের পুলিশ, নবীগঞ্জ ও শায়েস্তাগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট উদ্ধারকাজ শুরু করে। একে একে বের করে আনা হয় আটটি মরদেহ।
দুর্ঘটনায় পরিবারের তিন সদস্য নিহতের ঘটনায় চালকের বিরুদ্ধে শেরপুর থানায় মামলা করেছেন আবু তাহের। মঙ্গলবার বিকেলে তিনি মামলাটি করেন।
এদিকে সোমবার রাত ১১টার দিকে জানাজা শেষে বাড়ির পাশেই একটি টিলায় মারিয়া, তার মা ও চাচিকে দাফন করা হয়। বুকে পাথর বেঁধে ‘সোনার প্রতিমা’কে মাটি চাপা দিয়েছেন বাবা আবু তাহের।