খাগড়াছড়ি জেলায় দুই বীরাঙ্গনা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও সরকারি সহায়তা চেয়েছেন। বর্তমানে নিঃসঙ্গ ও অসহায় দিন যাপন করতে হচ্ছে এই দুই বীরাঙ্গনাকে।
পাহাড়ি দুই বীরাঙ্গনার একজন হ্লামাসং মারমা (৭৪)। তিনি জেলার মহালছড়ি উপজেলার বাবুপাড়ায় থাকেন। অন্য জন চেংসামা মারমা (৬৮) জেলার পানছড়ি উপজেলার যৌথ খামার মারমা পাড়ায় আত্মীয়ের বাসায় থাকেন।
সম্প্রতি নিউজবাংলার প্রতিনিধি এই দুই বীরাঙ্গনার সঙ্গে দেখা করে তাদের অবস্থা জানার চেষ্টা করেছেন।
হ্লামাসং মারমা বর্তমানে কানে খুবই কম শুনতে পান। ১৯৭১ সালের সেই দুঃসহ ঘটনার পর থেকে তিনি অনেকটাই নিশ্চুপ। সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে রাখেন।
প্রতিবেশীরা জানান, এমনিতেই তিনি কম কথা বলেন। আধা পাকা একটি ঘরে একাই থাকেন। একই পাড়ায় আলাদা আলাদা ঘরে নিজেদের পরিবার নিয়ে থাকেন তার এক ছেলে ও এক মেয়ে। তারাই হ্লামাসংকে দেখাশোনা করেন।
প্রতিনিধি তার সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি। শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন।
প্রতিবেশী রাসং মারমা (৭২) জানান, হ্লামাসঙের কারণে মহালছড়ি এলাকার অনেক মানুষ পাকিস্তানি হানাদারের বন্দুকের গুলি থেকে রক্ষা পেয়েছিলেন। যে দিন পাকিস্তানি সেনারা (তার ভাষায় পাঠানরা) মহালছড়িতে আসে সেদিন মহালছড়ির আশে পাশের সব ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দেয়। তখন গ্রামের মানুষ জঙ্গলে পালিয়ে যায়।
তিনি আরও জানান, পাঠানরা (পাকিস্তানি সেনা) এলাকার কিছু গণ্যমান্য ব্যক্তিকে আটক করে মারধর করে। খুঁজতে থাকে নারী। তখন এলাকার পাঁচ নারীকে পাঠানদের হাতে তুলে দেয়া হয়।
রাসং মারমা জানান, তিনি তিন নারীকে চেনেন, বাকি দুজনকে চেনেন না। ওই তিন নারীর এক জন হ্লামাসং।
হ্লামাসংকে মহালছড়ি হানাদার ক্যাম্পে (বর্তমান খাদ্য গুদাম) নিয়ে বেশ কয়েক দিন রেখে নির্যাতন করা হয়।
বীরাঙ্গনা হ্লামাসং মারমার জন্য আক্ষেপ করে প্রতিবেশী রাসং আরও জানান, তিনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাননি, তাকে স্থায়ীভাবে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হয়নি। তবে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে তাকে বিভিন্ন সময় সহায়তা করা হয়েছে। জীবনের শেষ বেলায় হলেও তাকে বীরাঙ্গনা হিসেবে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেয়া উচিত।
খাগড়াছড়ির আরেক বীরাঙ্গনা চেংসামা মারমা থাকেন তার ভাইয়ের ছেলের বাসায়। তার স্বামী-সন্তান নেই।
চেংসামা মারমার সঙ্গে এই প্রতিনিধির দেখা হয় পানছড়ি উপজেলার যৌথ খামার মারমা পাড়ায়। তিনি খোলামেলাভাবে ’৭১ এর দুঃসহ স্মৃতির কথা জানান।
তিনি জানান, ১৯৭১ সালে যুদ্ধ শুরুর আগে তার বিয়ে হয়। তখন তার বয়স ১৫-১৬ বছর। কিন্তু বিয়ের দেড় বছর পর তাদের বিচ্ছেদ ঘটে। যুদ্ধের সময় এক রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা চেংসামাকে পানছড়ি সদরের ফাতেমা টিলা এলাকার নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। নেয়া হয় মানিকছড়ি রাজবাড়িতে।
চেংসামা মারমা। ছবি: নিউজবাংলা
মানিকছড়ির মং রাজবাড়িতে হানাদারদের ক্যাম্প ছিল। সেখানেই তাকে তিন থেকে চার মাস রেখে নির্যাতন করা হয়। যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে সৈন্যরা তাকে ফেলে চলে যায়।
তিনি আরও জানান, এই ঘটনার পর এলাকার মানুষ তাকে গ্রহণ করতে চায়নি। তবে তার আপন ছোটো ভাই খিলুঅং মারমা তাকে আশ্রয় দেয়।
খিলুঅং মারমা জানান, চেংসামা ঘটনার শিকার। সমাজ তাকে বাঁকা চোখে দেখলেও, সে তো বোনকে ফেলে দিতে পারে না। তাই সে তাকে আশ্রয় দিয়েছে।
বীরাঙ্গনা চেংসামা মারমা জানান, এই ঘটনার পর থেকে তার আর সংসার করা হয়নি। বর্তমানে সে ভাই, ভাতিজা, আত্মীয়দের বাসায় থাকেন। নিজের এখনও কোনো ঘর নেই।