দুর্নীতি প্রতিরোধে দুর্নীতি দমন কমিশনসহ সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানকে ‘চুনোপুঁটি’ টানাটানির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে সত্যিকারের প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)।
দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রধানের মেয়াদপূর্তি আসন্ন হওয়ায় আগামীর দুদককে কার্যকর সংস্থা হিসেবে দেখতে চায় টিআইবি।
এক্ষেত্রে আইনানুগ প্রক্রিয়া অনুসরণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করে দলীয় রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়ে সৎ, যোগ্য, নিরপেক্ষ, নেতৃত্ব গুণাবলীসম্পন্ন, দৃঢ়চেতা ও পেশাদার নেতৃত্বের নিয়োগ সরকার নিশ্চিত করবে বলেও আশা করছে টিআইবি।
কাল ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস সামনে রেখে এক বিবৃতিতে টিআইবি এই আহ্বান জানায়।
করোনা অতিমারির আর্থ-সামাজিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে স্বাস্থ্য খাতসহ সংশ্লিষ্ট সব খাতে সংঘটিত অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিবৃতিতে টিআইবি জানায়, এক্ষেত্রে তারা রাজনৈতিক অঙ্গীকার এবং সরকারের জিরো টলারেন্স (শুন্য সহনশীলতা) নীতির কার্যকর বাস্তবায়নও দেখতে চায় ।
‘কোভিড-১৯ মোকাবিলায় চাই দুর্নীতির প্রতি শূন্য সহনশীলতা: দুর্নীতি থামাও, জীবন বাঁচাও’ এই প্রতিপাদ্যে নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে এ বছরও দিবসটি উদযাপন করছে টিআইবি।
জাতিসংঘের উদ্যোগে ২০০৩ সালের ৩১ অক্টোবর ‘আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী সনদ’ অনুমোদিত হয়। একই বছর ৯ থেকে ১১ ডিসেম্বর মেক্সিকোর মেরিডায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনে উচ্চ রাজনৈতিক পর্যায়ে স্বাক্ষরের উদ্দেশ্যে সনদটি উম্মুক্ত করা হয়। স্বাক্ষরের গুরুত্বকে স্মরণীয় রাখতে প্রতিবছর ৯ ডিসেম্বর জাতিসংঘ ঘোষিত আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
টিআইবি ২০০৪ সাল থেকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন করছে এবং ২০১৩ সাল থেকে দিবসটি সরকারিভাবে পালন ও স্বীকৃতির দাবি জানিয়ে আসছিল। এর ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে সরকারিভাবে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরোধী দিবস উদযাপন করছে।
বিবৃতিতে বলা হয়, সুশাসিত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়তে দেশে আইনের শাসন ও জবাবদিহিমূলক সরকার প্রতিষ্ঠার বিকল্প নেই। তাই সব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান বিশেষ করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, প্রশাসন, বিচার প্রক্রিয়া, নির্বাচন কমিশন ও মানবাধিকার কমিশনের নিরপেক্ষতা, বস্তুনিষ্ঠতা, দক্ষতা ও পেশাদারিত্ব নিশ্চিতের পাশাপাশি গণমাধ্যম ও দেশবাসীর স্বাধীন মতপ্রকাশের সাংবিধানিক অধিকার অক্ষুণ্ন রাখার জোর দাবি জানায় সংস্থাটি।
করোনায় দেশে দুর্নীতি যে সর্বব্যাপী রূপ নিয়েছে এটাই এখন অপ্রিয় সত্য উল্লেখ করে বিবৃতিতে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘শূন্য সহনশীলতার’ ঘোষণা থাকলেও এখনকার বাস্তবতায় তা কী অর্থ বহন করে তা কেউই নিশ্চিত করে বলতে পারেন না। আমরা দেখতে পাচ্ছি -এই ঘোষণার বাস্তবায়ন আটকে যাচ্ছে শুধু চুনোপুঁটিদের টানাটানিতে। অথচ এই পর্যায়েই দুর্নীতির যে ভয়াবহতার কথা আমরা জেনেছি, তাতে এই প্রক্রিয়ার মূল কারিগর- যারা পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়ছে, তাদের অনিয়ম-দুর্নীতির ব্যাপ্তি ও আর্থিক মূল্য কী হতে পারে, সেটা চিন্তা করলেও আতঙ্কিত হতে হয়।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘একজন ছাত্রনেতার হাজার কোটি টাকা পাচার করার খবর দিয়েছে গণমাধ্যম মাত্র ক’দিন আগে। আরও ওপরের দিকের দুর্নীতিবাজ নেতাদের অবস্থা তো আমাদের কল্পনারও বাইরে। অথচ তাদের কারও বিষয়ে কোনো তদন্ত বা কার্যকর আইনি ব্যবস্থার খবর তো আমরা কখনও দেখিনি!’
“রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক অন্য যে কোনোভাবে ক্ষমতাবানরা বিচারহীনতা উপোভোগ করছে এমন অভিযোগ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘দুদক এক্ষেত্রে কার্যত ক্ষমতার বি-টিমের ভূমিকা পালন করছে। দুর্নীতি দমন ও এর কার্যকর প্রতিরোধে দুদককে কাগুজে বাঘের পরিচয় থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।’
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলছেন, ‘দুদকের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা, জাতীয় রাজস্ববোর্ড এবং বিশেষ করে অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসকেও তাঁদের নিরপেক্ষতা, দক্ষতা ও কার্যকরতার দৃশ্যমান উদাহরণ সৃষ্টি করতে হবে। অন্যথায় গগণচুম্বী অর্থ পাচারসহ সর্বব্যাপী দুর্নীতির রাশ টানা অসম্ভব।
তিনি বলেন, সম্প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রী কানাডার বেগমপাড়ায় অর্থপাচার সংক্রান্ত যে তথ্য প্রকাশ করেছেন তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যদিও বিভিন্ন গণমাধ্যম জানাচ্ছে এই তথ্য খণ্ডিত এবং কেবল একটি পেশাজীবী গোষ্ঠীর কথাই জানানো হয়েছে। আমরা আশা করব, সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে কানাডা সরকারের কাছে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িতদের ব্যাপারে তথ্য চাইবে।
একইভাবে মালেয়শিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ডসহ অন্যান্য দেশে বাংলাদেশ থেকে যে অর্থ পাচার হয়, তা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ও জাতীয়ভাবে স্বীকৃত যে পদ্ধতি আছে, তা সরকার অনুসরণ করবে। একই সঙ্গে পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনাসহ যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক বিচারের আওতায় আনবে।
ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘গণমাধ্যম ও দেশবাসী সরকারের প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং সহযোদ্ধা। অথচ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো কালাকানুনসহ অন্য আরও সব আইনের যথেচ্ছ অপব্যবহার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মারাত্মক প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে।’
তিনি বলেন, ‘দেশে মৌখিকভাবে স্বাধীন সাংবাদিকতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং মুক্ত গণমাধ্যমের প্রচার থাকলেও বাস্তবে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক উভয় পদ্ধতিতেই গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের সর্বাত্মক চেষ্টা চলছে। তাই অবিলম্বে মুক্ত সাংবাদিকতা ও সাধারণের মতপ্রকাশের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।’