সিরাজগঞ্জ-বগুড়া মহাসড়কের পাশে চন্ডিদাসগাঁতি বাজার সংলগ্ন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের স্কুল মাঠের এক প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘দুর্জয় বাংলা’।
২৮ ফুট দীর্ঘ এই ভাস্কর্যটি নতুন প্রজন্মকে জানান দিচ্ছে মহান মুক্তিযুদ্ধের কথা। দেশের কিশোর, নারী, যুবকসহ সব শ্রেণির মানুষের আত্মত্যাগের কথা। এর ফলেই এসেছে আমাদের এই সোনার বাংলা।
বগুড়ার বিখ্যাত ভাস্কর শিল্পী আমিনুল করিম দুলাল ও তার তিন সহযোগী মিলে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ শুরু করেন।
১৯৯২ সালে নির্মাণ করা হয় ভাস্কর্য ‘দুর্জয় বাংলা’। গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অর্থায়নে প্রায় সোয়া ছয় লাখ টাকা ব্যয়ে করা হয় ভাস্কর্যটি। ২৬ জন শ্রমিক প্রায় তিন মাস ধরে এই ভাস্কর্যটির নির্মাণ করেন।
নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার আগেই ভাস্কর আমিনুল করিম দুলাল মারা যান। সে সময় ভাস্কর্যের মুখের অবয়ব দেয়া হয়েছিল না। এরপর শিল্পী দুলালের তিন সহযোগী এই ভাস্কর্যটির মুখের অবয়ব নির্মাণ করেন।
ভাস্কর্যটি নির্মাণের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তৎকালীন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র সিরাজগঞ্জের প্রকল্প উপদেষ্টা সাইফুল ইসলাম শিশির।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, মুক্তিযুদ্ধের এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করতে তাকেও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছিল। বিশেষ করে ভাস্কর্যটির স্থাপনের স্থান থেকে খানিকটা দূরে রয়েছে একটি কবরস্থান। এ সময় স্থানীয় স্কুলের শিক্ষক ওয়াজেদ আলী ভাস্কর্যটি নির্মাণে তাকে নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন।
তিনি আরও জানান, সে সময়ে এই ভাস্কর্যটি নির্মাণ করতে ভাস্কর্য বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করা হয়। এতে সিরাজগঞ্জের তৎকালীন জেলা প্রশাসক জেড এম শফিকুল ইসলাম, পুলিশ সুপার মোখলেসুর রহমান, জেলা পরিষদ সচিব মশিউর রহমান, উপজেলা ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী কর্মকর্তা ভীম চরণ রায় এবং তিনি নিজে এই কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।
এ ছাড়া উপদেষ্টা কমিটিতে ছিলেন বিএনপি দলীয় তৎকালীন সংসদ সদস্য মির্জা মোরাদুজ্জামান, তৎকালীন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোতাহার হোসেন তালুকদার এবং জেলা জাসদের সভাপতি আবদুল হাই তালুকদার।
আবদুল হাই তালুকদার জানান, সিরাজগঞ্জ জেলার প্রথম মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ ‘দুর্জয় বাংলা’। এই শিল্পকর্মটির মাধ্যমে ফুটে উঠেছে মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তান বাহিনীকে রুখতে বাংলার সব শ্রেণি-পেশার মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টার চিত্র।
ভাস্কর্যটি ত্রিকোণ বেদির ওপর নির্মিত। বেদির তিন পাশের এক পাশে শোভা পাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বিপ্লবী সরকারের তথ্য অধিদফতর থেকে প্রকাশিত কয়েকটি পোস্টারের প্রতিচ্ছবি।
আরেক পাশে রয়েছে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের ওপর আরও একটি পোস্টারের প্রতিচ্ছবি।
বেদির উপরে মাছ ধরার টেটা হাতে দীপ্ত পায়ে দাঁড়িয়ে আছে ১০-১২ বছর বয়সী এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা। তার পাশেই মাথায় গামছা বেঁধে দৃপ্ত পদক্ষেপে দাঁড়িয়ে আছেন এক মহিলা মুক্তিযোদ্ধা। তার শক্ত মুঠিতে রয়েছে বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত পতাকা। আরেক পাশে রয়েছে লুঙ্গি পরনে উদোম গায়ে পেশিবহুল শরীরের এক যুবক মুক্তিযোদ্ধা। তার উত্তোলিত ডান হাতে শোভা পাচ্ছে রাইফেল আর বুকে রয়েছে বন্দুকের গুলিবোঝাই কার্তুজ।
৭ই মার্চে দেয়া বঙ্গবন্ধুর ভাষণে ‘তোমাদের যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করো’ এমন নির্দেশ বাস্তবায়নের পাশাপাশি বাংলার কৃষক-শ্রমিক কামার-কুমার- তাঁতি ছাত্র-শিক্ষক রাজনীতিবিদ আর বাংলার নারীদের সরাসরি সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের সম্মিলিত প্রয়াসের চিত্র ফুটে উঠেছে এই ভাস্কর্যটিতে।
সে সময়ে পাকিস্তান থেকে স্টোন চিপস এনে সাদা সিমেন্ট দিয়ে নিরেট ঢালাইয়ের মাধ্যমে এটি নির্মাণ করা হয়। সে সময়ে দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ভাস্কর্য নির্মিত হলেও জীবিত মানুষের ছাঁচে করা এই ভাস্কর্যটি ছিল অন্যতম।
ভাস্কর্যটিকে ঘিরে যে পোস্টারগুলো স্থাপন করা হয়েছে তাতে রয়েছে বরেণ্য চিত্রশিল্পী পটুয়া কামরুল হাসানের চিত্র ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে আসুন আমরা পশু হত্যা করি’। তাতে আরও রয়েছে রক্তলোলুপ ইয়াহিয়া খানের ছবি।
আরেকটি পোস্টারে শোভা পাচ্ছে ‘বাংলার কৃষক বাংলার শ্রমিক আজ সবাই মুক্তিযোদ্ধা’। আরেকটিতে রয়েছে গামছা মাথায় এক নারী মুক্তিযোদ্ধার ছবি।
ভাষা আন্দোলনকে ঘিরে আরও একটি পোস্টার শোভা পাচ্ছে বেদির পিছন অংশে। এই পোস্টারটি জানান দিচ্ছে ভাষা আন্দোলনের সিঁড়ি বেয়ে এসেছে আমাদের স্বাধীনতা।
সিরাজগঞ্জ জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের সভাপতি মামুনুর রশিদ মামুন জানান, প্রায় ৩০ বছর ধরে ‘দুর্জয় বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বহন করে চলেছে। তবে দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় তা কিছুটা হয়ে ক্ষয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস সংরক্ষণের জন্য ভাস্কর্যটি সংস্কার ও সংরক্ষণের দাবি জানান তিনি।