খান সাহেবের বাড়ি, গগন এমপির বাড়ি কিংবা রতন চেয়ারম্যানের বাড়ি— ঢাকার কেরানীগঞ্জের কলাতিয়া বাজার গিয়ে যে কারও কাছে জানতে চাইলে সহজেই মিলবে ঠিকানা। নাম তিন রকম। কিন্তু বাড়ি একটিই।
শুনলে আভিজাত কোনো বাড়ি মনে হয়। কিন্তু আদতে গ্রাম বাংলার আর ১০টা বাড়ির মতোই সাধারণ ঘর। বিশাল আঙিনা, সামনে পুকুর আর চারদিকে সারি সারি ফলদ গাছ।
এই সাদামাটা বাড়িটি ছিল প্রতিরোধ যুদ্ধের আঁতুড়ঘর। একাত্তরের আগে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতাদের গোপন নিরাপদ আশ্রয় ছিল এটা। আর বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের কালজয়ী ভাষণের আগ মুহূর্তে এটি পরিণত হয়েছিল দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম সশস্ত্র প্রশিক্ষণ শিবিরে।
ব্রিটিশ শাসনামলে এ ভিটার মালিক ছিলেন সামছুদ্দিন আহমেদ। ১৯৩৫ সালে সামছুদ্দিনকে বাড়িতে গিয়ে ব্রিটিশ রাজ ‘খান সাহেব’ খেতাব দেয়।
সাতচল্লিশের দেশভাগের সময় তিনি ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। তার চার সন্তান আনোয়ার উদ্দিন আহমেদ (তোতা মিয়া), আরফান উদ্দিন আহমেদ রতন, বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগন এবং হেলাল উদ্দিন আহমেদ মাখন।
বিত্ত-বৈভবে বেড়ে ওঠা এই চার সন্তানের সবাই ছিলেন শিক্ষিত। খান সাহেবের বড় সন্তান তোতা মিয়া ছাড়া বাকিরা ছিলেন ছাত্রলীগ কর্মী। তবে ভাইদের মধ্যে তৃতীয় বোরহান উদ্দিন গগন ছিলেন অন্যদের তুলনায় এগিয়ে। কারণ তার মধ্যে ছিল স্বভাবসুলভ নেতৃত্বের গুণ। সেটা দিয়েই ছাত্রলীগের প্রভাবশালী নেতা হয়ে যান তিনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন গগন।
বড় ভাই তোতা মিয়া ছিলেন মুসলিম লীগ নেতা। পরিবারের বর্তমান সদস্যরা বলছেন, মুসলিম লীগে বেশ প্রভাবশালী ছিলেন তিনি। তবে ভাইদের মধ্যে এ নিয়ে বিরোধ ছিল না। পরিবারের সদস্যদের দাবি, মুসলিম লীগের আড়ালে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন তিনি।
গগন ছাত্রলীগ নেতা হওয়ার পর থেকে তাদের বাড়িতে ছিল কেন্দ্রীয় নেতাদের আনাগোনা। এরই মধ্যে দেশজুড়ে চলছে আন্দোলন। বঙ্গবন্ধু তখন পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শোষণের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ করছিলেন।
‘৬৬-এর ছয় দফা, ‘৬৯-এর গণ অভ্যুত্থান– সবখানেই খান বাড়ির তিন ভাইয়ের ছিল সরব উপস্থিতি। ওই সময়ে ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে পশ্চিমারা কোনো হুলিয়া জারি করলেই গগনদের বাড়ি ছিল আশ্রয়স্থল। পুলিশের চোখ ফাঁকি দিয়ে সেখানে অবস্থান নিতেন তারা। সেখানে বসেই ঠিক করতেন পরের কর্মসূচি। এখানে আশ্রয় নিয়েছেন যারা, তাদের মধ্যে আছেন শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন প্রমুখ।
গত শুক্রবার বাড়িটির সামনে গিয়ে দাঁড়ালে চোখে পড়ে এটির প্রকৃত নাম। সামছুদ্দিন কুঞ্জ। এটি বানানো হয়েছে ১৯৫৩ সালের ৩ মার্চ। একাত্তরের রক্তঝরা মার্চে এসে বাড়িটি পরিণত হয় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে।
বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগন আর নেই। বেঁচে নেই বাকি তিন ভাইয়ের কেউই। বাড়ির ঠিক সামনে চিরনিদ্রায় শায়িত তারা। মুজিববাহিনীর বৃহত্তর ঢাকা জেলার অধিনায়ক গগনের স্মৃতি হাতড়ে এখনও আছেন সহধর্মিনী ইয়াকুত আরা আহমেদ। তার মুখে জানা হলো এসব ইতিহাস।
শামসুদ্দিন পেয়ারার লেখা আমি সিরাজুল আলম খান: একটি রাজনৈতিক জীবনালেখ্য বইয়ের ‘স্বাধীনতার প্রস্তুতিপর্ব’ অধ্যায়ে সিরাজুল আলম খানের উদ্ধৃতিতে বাড়িটির কথা এভাবে বলা হয়েছে:
‘… ১৯৬৬-৬৭ এ দুই বছর আমরা স্বাধীনতার বিষয়টিকে শুধু শ্লোগানে সীমাবদ্ধ না রেখে পরবর্তী পর্যায়ের করণীয়সমূহ নিয়েও চিন্তাভাবনা করতে শুরু করি। এজন্য কেরানীগঞ্জ থানার কলাতিয়ায় রতন-গগন-মাখনদের বাড়িটিকে আমরা আমাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করতে থাকি। এই তিন ভাইয়ের বড়জন রতন আমার খুব ঘনিষ্ঠ ছিল। অবস্থাপন্ন এই পরিবারটি শুধু আমাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাই নয়, বরং আর্থিক ও অন্যান্যভাবে আমাদের সশস্ত্র কার্যক্রমেও সহায়তা করে।…’
বাড়ি ঘুরে দেখার মাঝে পরিচয় হলো খান সাহেবের ছোটো ছেলে হেলাল উদ্দিন আহমেদ মাখনের সন্তান শিহাব উদ্দিন আহমেদ রানার সঙ্গে। বাবা-মায়ের কাছে শোনা গল্পের ঝাঁপি মেলে ধরেন তিনি নিউজবাংলার কাছে।
একাত্তরের মার্চে শুরু দিকের কথা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের বাঙালি ক্যাপ্টেন মাহফুজ আলম বেগ বিদ্রোহ করে চলে এলেন ঢাকায়। ৩২ নম্বরের বাড়ি গিয়ে দেখা করেন তিনি বাঙালির মুক্তি সংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে। পালিয়ে আসা ক্যাপ্টেন বেগের থাকার জন্য একটা নিরাপদ স্থান দরকার। তখন নিরাপদে লুকানোর জায়গা বলতে ওই একটাই: গগন-রতনদের বাড়ি। বঙ্গবন্ধু বেগকে ওখানেই যাওয়ার নির্দেশ দেন। কেরানীগঞ্জের এই বাড়িতেই আশ্রয় নিয়েছিলেন ক্যাপ্টেন বেগ।
রানার কাছে আরও জানা গেল, গোপন আশ্রয়ে এসেও চুপটি থাকার লোক ছিলেন না ক্যাপ্টেন বেগ। সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য নিতে থাকেন প্রস্তুতি। আশপাশের গ্রামের ছাত্রলীগকর্মী আর যুবকদের দিতে থাকেন সশস্ত্র প্রশিক্ষণ।
রানা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই আমাদের বাড়িতে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম সশস্ত্র সংগ্রামের প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করা হয়। নেতৃত্বে ছিলেন ক্যাপ্টেন বেগ চাচা। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং, যতটুকু সম্ভব হইছে। তাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভারতে পাঠানো হইতো হাইয়ার ট্রেনিংয়ের জন্য।
‘আর ওই সময়ে মুজিব বাহিনী এবং ছাত্রলীগের এমন কোনো নেতা ছিলেন না, যিনি আমাদের বাড়িতে সাময়িক আশ্রয় না নিছে। সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মণি, রাজ্জাক চাচা, তোফায়েল চাচা, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আব্দুর রব, নূরে আলম জিকো— এরকম তৎকালীন সব নেতারাই এসেছেন এই বাড়িতে।’
গগনের স্ত্রী ইয়াকুত আরা আহমেদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অস্ত্রশস্ত্র সব এই বাড়িতেই থাকতো। লোকজন আসতো, প্রশিক্ষণ নিতো। খাওয়া-দাওয়াও এখানেই করতেন সবাই।’
ইয়াকুত আরা আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধুর সাত মার্চের ভাষণের পর বদলে গেল দৃশ্যপট। তরান্বিত হলো প্রশিক্ষণের গতি।
ইয়াকুত বললেন ২৫ মার্চের রাতের ভয়াবহতার কথা। সেদিন রাতে তিনি ঢাকায় ছিলেন। পরদিন সকালে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে কোনোরকমে ছুটে যান মাতুআইলে। পরে জানতে পারেন, ঢাকা ছেড়ে অনেক নেতারা আশ্রয় নিয়েছেন তাদের বাড়িতে। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, তোফায়েল আহমেদসহ আরও অনেকে গেছেন।
ইয়াকুত আরা বলেন, ‘২৫শে মার্চের পরে নেতারা যারা এখানে এসেছিলেন, তারা সবাই ভারতে চলে যান। স্থানীয় ছেলেদের এখানে ট্রেনিং হতো, তাদের গুলি চালনা, বোমা বিস্ফোরণের কৌশল শেখানো হতো।’
মুজিবনগর দিবসের স্মৃতিকথা শিরোনামে এক নিবন্ধে আওয়ামী লীগ নেতা তোফায়েল আহমেদ লিখেছেন, ‘…কেরানীগঞ্জে আমাদের সাবেক সংসদ সদস্য বোরহানউদ্দিন গগনের বাড়িতে আমরা আশ্রয় গ্রহণ করি। জাতীয় নেতা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেব এবং এ এইচ এম কামরুজ্জামান সাহেব, মণি ভাই, সিরাজ ভাই, রাজ্জাক ভাই এবং আমিসহ স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ সেখানে উপস্থিত ছিলেন। সিদ্ধান্ত হলো মণি ভাই ও আমি, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান সাহেবকে নিয়ে ভারতের দিকে যাব। বঙ্গবন্ধু আগেই আমাদের জন্য বাসস্থান নির্ধারণ করে রেখেছিলেন।…’
‘অনন্য দিন ১৭ এপ্রিল’ শিরোনামের আরেকটি নিবন্ধে তোফায়েল আহমেদ উল্লেখ করেন, ‘১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংস গণহত্যা শুরু হয়। ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মধ্যেই আমরা কয়েকজন ২৯ মার্চ কেরানীগঞ্জ থেকে দোহার-নবাবগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ, সারিয়াকান্দি, বগুড়া হয়ে ৪ এপ্রিল ভারতের মাটি স্পর্শ করি। ...’
আবুল মনসুর আহমেদেরআমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও ইতিহাসনির্ভর বইতে বাড়িটির কথা আছে।
একাত্তরের জুনের দিকে এসে ওই বাড়ির সন্ধান পেয়ে যায় পশ্চিমা হানাদারের দল। ইয়াকুত আরা বলেন, ‘তারা আসার খবর পেয়ে আমরা বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলাম। ওরা এসে আমার ভাসুরের বাসায় প্রথমে ঢোকে। সেখানে সবকিছু লণ্ডভণ্ড করছে। আমার ঘরেও আসছিল। আমি ঘরে ছিলাম না। বই-টই সমস্ত কিছু লণ্ড ভণ্ড করে দিয়ে যায়।’
তখন অবশ্য গগন দেশে ছিলেন না। উচ্চতর প্রশিক্ষণ নিতে চলে যান ভারতের দেরাদুনে। বাড়িতে পাকিস্তানি সেনার আক্রমণের পর ইয়াকুত আরাও ভারতে চলে যান। দশজন মুক্তিযোদ্ধার একটি দলের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গে আগরতলা সীমান্ত দিয়ে তিনি ভারতে ঢোকেন। সেখানে একটি মাটির ঘরেই তার আশ্রয় হয়।
ইয়াকুত বলেন, তিনি যাওয়ার পরেই তার স্বামী গগন দেশে ঢুকে শুরু করেন সম্মুখ সমর। বৃহত্তর ঢাকা জেলা মুজিব বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন গগন। ঢাকা জেলায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করা ও নেতৃত্ব দেয়ার কাজ করেন তিনি।
দেশ স্বাধীন হবার প্রায় মাস তিনেক-চারেক পর দেশে ফেরেন ইয়াকুত আরা আহমেদ। আবারও ফিরে পান তার সংসার। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে নতুন দেশের যাত্রা শুরু হয়। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের হয়ে কেরানীগঞ্জ থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বোরহান উদ্দিন আহমেদ গগন।