পাঁচ মাস করোনাভাইরাসের সঙ্গে লড়ে নাটকীয়ভাবে সুস্থ হয়ে হইচই ফেলে দেয়া বাংলাদেশি এক শ্রমিক এখন দেশে ফেরার অপেক্ষায়। নিজের আট মাস বয়সী সন্তানকে দেখতে মুখিয়ে তিনি।
রাজু সরকার নামে মৃত্যুঞ্জয়ী বাংলাদেশি এই শ্রমিককে নিয়ে রোববার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সিঙ্গাপুরের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম দ্য স্ট্রেইট টাইমস।
করোনা আক্রান্ত হয়ে রাজু যখন হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ কেন্দ্রে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছিলেন মার্চে তখন দেশে তার স্ত্রীর কোল জুড়ে আসে ছেলে সন্তান। একমাত্র সন্তান সাফুনের বয়স এখন আট মাস। তাকে কোলে নিতে তর সইছে না রাজুর।
বাংলাদেশের গাজীপুরের জয়দেবপুরে বাড়ি রাজু সরকারের। গত বছরের জুন থেকে দেশে ফেরা হয় না তার। প্রায় এক মাস আগে সাফুন যখন বাবা ডাকতে শিখল, ফোনে মধুর সেই শব্দ শুনে কেঁদে ফেলেছিলেন বলে জানালেন। বললেন, শিশু ছেলের জন্যই বেঁচে থাকার প্রেরণা পান তিনি।
‘আমি তার কাছ থেকে শক্তি পাই। বাচ্চাটি দ্রুত বড় হচ্ছে, তাকে এখনই আমার বিয়ে দিতে হবে’-মজা করে বলেন রাজু।
গত ফেব্রুয়ারিতে করোনায় আক্রান্ত হন ৪০ বছর বয়সী রাজু। এরপর তাকে সিঙ্গাপুরের ট্যান টক সেং হাসপাতালে থাকতে হয় প্রায় পাঁচ মাস সময়। অর্ধেক সময় কাটে আইসিইউতে।
গত জুনে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পান রাজু। করোনামুক্ত হলেও রক্তে প্লাটিলেটের মাত্রার পতন, হৃদযন্ত্রের সমস্যাসহ তার অন্যান্য স্বাস্থ্য জটিলতা দেখা দেয়। তবে এখন ভালো বোধ করছেন বলে জানালেন তিনি, নিতে হচ্ছে না কোনো ওষুধ।
রাজুর আশা, চলতি মাসের শেষ দিকে চিকিৎসকের কাছ থেকে সব ধরনের ছাড়পত্র পেয়ে যাবেন। পরিবারকে দেখতে দেশে ফিরতে পারবেন ফেব্রুয়ারি বা মার্চে। বলেন, ‘তা না হলে, সিঙ্গাপুরে আমাকে আরও লম্বা সময় থাকতে হবে।’
রাজুর সুস্থতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন তার চিকিৎসকেরাও।
হারিয়ে যাওয়া ওজনও ফিরে পাচ্ছেন রাজু। তার বর্তমান ওজন ৫৯ কেজি। অসুস্থ হওয়ার আগে ওজন ছিল ৬৪ কেজি। এক পর্যায়ে তা কমে দাঁড়িয়েছিল ৪০ কেজি।
রাজুর সুস্থতায় বিস্ময় প্রকাশ করেছিলেন তার চিকিৎসকেরাও। তার অক্সিজেন লেভেল এতটাই নেমে গিয়েছিল যে, তা আর নাও উঠতে পারে বলে ভেবেছিলেন চিকিৎসকেরা।
শরীরে ওপর কঠিন দখলে ক্যারিয়ার নিয়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে রাজুর। একটি আইটি ফার্মে সেফটি কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কাজ করতেন তিনি। এখন তার আশা, নিয়োগ কর্তা যেন তাকে কম পরিশ্রমের কোনো কাজ দেন।
‘আমার শারীরিক ক্ষমতা আগের মতো নেই। আগে আমি আমার শরীরে অবস্থার কথা ভাবতাম না। কাজের জন্য আমাকে যেখানে বলা হতো সেখানেই যেতাম। খাওয়া, না খাওয়ার ব্যাপারটিও চিন্তা করতাম না। কিন্তু এখন আমাকে নিজের প্রতি যত্নশীল হতে হবে।’
কাজের অবস্থা পরিবর্তন না হলে হয়তো একেবারে দেশে চলে আসতে পারে বলে জানালেন রাজু।
দেশে মুদির দোকান আছে রাজুর শ্বশুরের। সেখানে কাজের প্রস্তাব দেয়া হয়েছে বলে জানালেন তিনি। তবে তার ইচ্ছা, বাংলাদেশ সরকার যেন তাকে এককালীন কোনো অনুদান বা সরকারি একটা চাকরি দিয়ে চলার ব্যবস্থা করে দেয়।
বর্তমানে কোম্পানি থেকে দেয়া একটি বাসস্থানেই আছেন রাজু। পরিবারের সঙ্গে ফোনে কথা বলে বা ল্যাপটপে ইসলামিক বিষয়স্তু নিয়েই সময় কাটছে তার।
মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি মনে করি, আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছে। আমি সঠিক পথে চলার চেষ্টা করছি।’
রাজুর স্ত্রী জানজিদা আখতার ও ছেলে সাফুন
রাজুর জন্য ফেরার অপেক্ষায় থাকা দেশে তার ১৮ বছর বয়সী স্ত্রী জানজিদা আখতার ফোনে বলেন, ‘বিদেশের মাটিতে এমন দুর্ভাগ্যজনক ঘটনাটি ঘটল। তাকে এখন আর বিদেশে থাকতে দিতে ইচ্ছা করে না।’
গাজীপুরের কালনি থেকে সানজিদা যখন ফোনে কথা বলছিলেন তখন কোলে থাকা তার ছেলে সন্তানের আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল। তিনি জানান, স্বামীর অসুস্থতার কথা মনে পড়লে এখনও চোখ ভিজে ওঠে তার।
সানজিদা জানান, রাজুর বিদেশে থাকা লাগবে না। দেশে এসে কিছু একটা করুক।