১৯৭১ এর শুরুতেই অনেকে বুঝে গিয়েছিলেন- সশস্ত্র সংগ্রামই বাঙালির মুক্তির চূড়ান্ত পথ। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ আসন্ন। মানসিকভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি যারা নিতে শুরু করেছিলেন, তাদেরই একজন মুক্তিযুদ্ধে এক নম্বর সেক্টরের কমান্ডার অবসরপ্রাপ্ত মেজর রফিকুল ইসলাম।
সে সময়ে ইপিআরের চট্টগ্রাম অঞ্চলের অ্যাডজুটেন্ট ছিলেন তিনি। পরিস্থিতি বুঝতে পেরে মার্চের শুরু থেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন এই সামরিক কর্মকর্তা। মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে বীর উত্তম খেতাব দিয়ে সম্মানিত করেছে বাংলাদেশ। বিজয়ের মাসে নিউজবাংলার জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আশিক হোসেনের কাছে মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল সময়ের নানা স্মৃতি তুলে ধরেছেন তিনি।
মার্চের শুরুতেই আপনি সশস্ত্র লড়াইয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। কোন পরিস্থিতিতে মনে হলো যুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী, একে ঠেকানোর আর কোনো উপায় নেই?
সত্তর সালে যে নির্বাচন হয়েছিলো তার পেছনে দীর্ঘদিনের একটা রাজনৈতিক সংগ্রামের ইতিহাস ছিল এবং সে ধারাবাহিকতায় বাঙালি জাতি ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য একটা মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছিল। এর পেছনে রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগের একটা বিরাট ভূমিকা ছিল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দীর্ঘদিন ধরে সে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন, তার সঙ্গে আরো অনেক নেতৃবৃন্দ ছিলেন।
মার্চ মাসের ৩ তারিখে ঢাকায় পাকিস্তান ন্যাশনাল এসেমব্লির অধিবেশন বসার কথা ছিল। পাকিস্তানিরা এটার বিরোধিতা করেছিল। প্রকাশ্যেও করেছিল, আবার গোপন চক্রান্তও ছিল। এটা আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম, যারা সেনাবাহিনীতে আছে তাদেরও কেউ কেউ, রাজনৈতিক নেতা যারা সিনিয়র ছিলেন তারা অবশ্যই এটা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। যখন ৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করা হলো ১ মার্চের ঘোষণায়, তখন স্বভাবতই সমস্ত বাংলাদেশ, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। অধিবেশন স্থগিতের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন, ২ মার্চ ঢাকায় আর ৩ মার্চ সারাদেশে হরতাল হবে।
৩ মার্চ চট্টগ্রামের বাঙালিদের একটা প্রতিবাদী মিছিল ওয়্যারলেস কলোনি দিয়ে শহরের দিকে আসছিল। অবাঙালি ও পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বেলুচ রেজিমেন্টের একটি গ্রুপ, হয়ত ৩০ জন ৪০ জন হবে, এরা বেসামরিক পোশাকে কিন্তু সামরিক অস্ত্র নিয়ে আগে থেকেই অবস্থান করছিল। তারা মিছিলে আক্রমল করল, সামরিক অস্ত্র দিয়ে গুলিবর্ষণ করলো, সেভেন পয়েন্ট সিক্স টু রাইফেল দিয়ে। এতে শতাধিক বাঙালি নিহত ও দুই থেকে আড়াইশ আহত হন। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে যারা আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিলেন তারা জানালেন এই বুলেট পাওয়ার ঘটনা। তখন আমি খোঁজ নিয়ে দেখলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লোক বেসামরিক পোশাকে অস্ত্র নিয়ে সেখানে ছিল, তারাই গুলিটা করেছে। তখন আমি চিন্তিত হয়ে পড়লাম। সেনাবাহিনীর কোনো ইউনিট, কোনো সৈনিক, বেসামরিক পোশাকে অবাঙালিদের সঙ্গে থাকা তাও সামরিক বাহিনীর অস্ত্র নিয়ে! এটা তাদের রেজিমেন্ট প্রধান, লেফটেন্যান্ট কর্নেলের একার সিদ্ধান্ত হতে পারে না, বিগ্রেড কমান্ডারেরও না, জিওসিরও না। সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত না হলে সৈনিকরা এ ধরনের কাজ করার সাহস পাবে না। আমি তখন বুঝলাম বাঙালির স্বাধীকারের আন্দোলন দমানোর জন্য পাকিস্তানিরা গণহত্যার পথে এগুচ্ছে।
এদিকে, ১ মার্চের ঘোষণার আগেই ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে পিআইএ এর বোয়িং উড়োজাহাজে করে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৪টা ফ্লাইট ঢাকা বিমানবন্দরে পশ্চিমা সৈন্য নিয়ে আসা শুরু করে। ওই দিনই চট্টগ্রাম বন্দরের বহিঃনোঙরে সোয়াত নামের একটি জাহাজ তারা নিয়ে আসে, প্রায় ১০ হাজার টন অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে। তখন ভারতের কোনো সৈন্য আমাদের সীমান্তে নাই। আমি ভাবলাম, এত অস্ত্র তাহলে কী জন্য এনেছে?
বুঝতে পারলাম, এই অস্ত্র গোলাবারুদ বাঙালিদের বিপক্ষে ব্যবহার করা হবে। রাজনৈতিক নেতাদের মাধ্যমে বিষয়টি বাঙালি শ্রমিক, যারা চট্টগ্রাম বন্দরে কাজ করে, জাহাজ থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ যারা নামায় তাদের মধ্যে আমরা ছড়িয়ে দিলাম। তারা বললো, যে অস্ত্র দিয়ে আমাদের মারবে, যে অস্ত্র গোলাবারুদ আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হবে আমরা সেগুলো নামাব না। তখন একটা অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়ে গেলো, আমরা সোয়াত থেকে অস্ত্র গোলাবারুদ নামাতে বাধা দিলাম, শ্রমিকদের মাধ্যমে। আমাদের কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেল- একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে তারা আসছে আর এটা বাঙালির বিরুদ্ধে।
আমি তখন সিদ্ধান্ত নিলাম, তারা যদি গণহত্যার দিকে যায়, যদি আকস্মিক আক্রমণ চালায় তাহলে তাদের টার্গেট কারা হবে? এক হবে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার সহচর যারা আছেন নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামান সাহেবসহ আরো যারা সিনিয়র নেতৃবৃন্দ আছেন এবং যারা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে পারবেন সরাসরি। পাশাপাশি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যেসব কর্মকর্তা পূর্ব পাকিস্তান বা আজকের বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গা যেমন বেঙ্গল রেজিমেন্ট, তৎকালীন ইপিআর এসব জায়গায় যে সব বাঙালি কর্মকর্তা পোস্টিংয়ে আছে, তারা হবেন দ্বিতীয় টার্গেট। এর কারণ, আমরা নেতৃত্ব দিয়ে সৈনিকদের সংগঠিত করতে পারব। তখন আমি ভাবলাম, তারা যদি আগে আক্রমণ করতে পারে তাহলে আমার বাঁচার সম্ভাবনা কম। যদি বাঁচতে চাই বা বিজয়ী হতে চাই, যখন বুঝতে পারব যে তারা আক্রমণ করবে তার আগেই আমি তাদের আক্রমণ করব। ভাবলাম, ঝুঁকি তো নিতেই হবে, না হলে কোনো ফলাফল আসবে না। এজন্যই আমি প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম।
প্রস্তুতি শুরু করলেন কীভাবে? ইপিআরের বাঙালি সদস্যদেরই বা সংগঠিত করলেন কীভাবে? তারাই বা কেন আপনার নেতৃত্ব মেনে নিলো?
আমি সে সময় সেনাবাহিনী থেকে ডেপুটেশনে চট্টগ্রাম সেক্টর ইপিআরের অ্যাডজুট্যান্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। ইপিআরের সৈন্য ছিল শতকরা ৭০ থেকে ৭৫ ভাগ বাঙালি, আর ২০ থেকে ২৫ ভাগ ছিল অবাঙালি। এ অবাঙালি সৈন্যদের অত্যাচারে বাঙালি সৈন্যরা একেবারে কোনঠাসা ছিলো। সব কিছু থেকেই তারা ছিল বঞ্চিত। অবাঙালিরা সব কিছুতেই প্রাধান্য পেত। এতে স্বাভাবিকভাবেই তাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ বিরাজ করছিল। আমি সে অসন্তোষের সুযোগ নিয়ে তাদের বোঝালাম যে, তোমাদের উপর এ অত্যাচার আজীবন চলতে থাকবে। এর থেকে মুক্তির একটি মাত্র পথ আছে। এ দেশ যদি তোমরা মুক্ত করতে পার, তাহলেই তোমরা ভালো থাকবে, নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হবে। কাজেই আমাদের যুদ্ধের প্রস্তুতি নিতে হবে। বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে আমার একটা গ্রহণযোগ্যতা ছিল, আমাকে বিশ্বাসও করত বেশি। সোয়াত জাহাজের বিষয়টি তাদের জানিয়ে আবার বোঝালাম, এই দেখো সৈন্য নিয়ে আসছে, অস্ত্র গোলাবারুদ এনেছে তোমাদের মারার জন্য। এতে করে তাদের ভেতরে উত্তেজনা আরো বেড়ে যায়।
কিন্তু এই যে এদেরকে যে যুদ্ধে নামাব, কি লক্ষ্যে নামাব? আমি তখন ঠিক করলাম, লক্ষ্য হবে চট্টগ্রাম অঞ্চলে যত অবাঙালি সৈন্য আছে তাদের ধ্বংস করা। আমি তখন শুধু চট্টগ্রাম নিয়েই ভাবছি। আমরা এমন সুসংগঠিতভাবে আকস্মিক আক্রমণ চালাব যেন তারা বুঝতে না পারে। তাদেরকে ধ্বংস করব, যাদের ধ্বংস করতে না পারি বন্দি করে রেখে দেব, চট্টগ্রাম শহরকে মুক্ত করে দখলে নেয়াই ছিলো আমাদের প্রাথমিক লক্ষ্য। শহরের গুরুত্বপূর্ণ অংশে, বড় বড় পাহাড়ের চূড়ায়, বড় ভবনে আমাদের মেশিনগান বসানো হবে, তারপর মর্টার এন্টি ট্যাংক যত ওয়েপন সব আমরা বসাব। এমন পরিকল্পনা করলাম যাতে বন্দরে থাকা সৈন্যরা বেড়িয়ে আসতে না পারে আর ক্যান্টনমেন্টে থাকা সেনারাও যেন শহরের দিকে আসতে না পারে। এছাড়া ফেনীর মহুরী নদী, ফেনী নদী যেটা শুভপুর দিয়ে মহুরীর সঙ্গে মিলেছে এ দুটো অঞ্চলে ডিফেন্স নিলে ঢাকা-কুমিল্লা থেকে কোনো সৈন্য চট্টগ্রামে আসতে পারবে না। এ কৌশল ঠিক রেখে মূল পরিকল্পনা সাজালাম।
চট্টগ্রামে প্রায় ১৮ শ সৈন্য ছিল ইপিআরে। এর মধ্যে ১২শ থেকে ১৩শ ছিল বাঙালি, বাকিরা অবাঙালি। অবাঙালিদের বেশিরভাগ ছিলো চট্টগ্রাম শহরে। বাকিরা ছিলো সীমান্ত পোস্টে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তখন ছিল হালি শহরে ইপিআরের হেড কোয়ার্টার নিয়ন্ত্রণে নেয়। সে সময় এখানে প্রায় আড়াইশ অবাঙালি সৈন্য ছিল। চ্যালেঞ্জ ছিল এ অবাঙালি সৈন্যদের ধ্বংস করা, কিন্তু এটা চ্যালেঞ্জ চি্ট তারা বুরে কোন এমনভাবে করতে হবে যেন একটি গুলির শব্দও শোনা না যায়। কারণ আশেপাশে সব অবাঙালিদের বাস। তারা বুঝে ফেললে ক্যান্টনমেন্টেও খবর দিতে পারে। আমাকে সার্বিকভাবে এ কাজে সহযোগিতা করেছিলেন সুবেদার জয়নাল, হাওয়ালদার ওয়াদুদ, হাওয়ালদার সিরাজুল ইসলাম, আরো কয়েকজন জেসিও ছিলেন। এরা ছিলেন আমার বিশ্বস্ত। তাদেরকে কৌশলে যার যতটুকু জানার দরকার জানিয়ে রেখেছিলাম। কোন কোম্পানি কোন প্লাটুন কোন জায়গায় অবস্থান নেবে এটা আমরা ঠিক করে ফেলি। সীমান্তে অবাঙালি সৈন্যদের কিভাবে বন্দি করা হবে তারও এটা ছক তৈরি হয়। এভাবেই যুদ্ধের একটা প্রস্তুতি আমি নিয়ে ফেললাম।
তাদেরকে একটি সাংকেতিক বার্তা দিয়ে দিলাম, যেটি থেকে তারা যুদ্ধ শুরুর সংকেত পাবে। একটি ছিল ‘অ্যারেঞ্জ সাম উড ফর মি’, এর অর্থ প্রস্তুতি নাও আধ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধ শুরু করতে হতে পারে। দ্বিতীয়টি ছিলো ‘ব্রিং সাম উড ফর মি’ অর্থাৎ সীমান্তে তোমার অবস্থানে যত অবাঙালি সৈন্য আছে তাদের ধ্বংস করো এবং শহরে এসে নির্ধারিত স্থানে অবস্থান নাও। এই কোড প্রত্যেক পোস্টে একজন মাত্র জানত।
সে সময় চট্টগ্রামের রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কি আপনার যোগাযোগ হয়েছিল? আপনার প্রস্তুতি নিয়ে তাদের মনোভাব কি ছিল?
৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর ভাবলাম, আমি তো শুধু সৈন্য নিয়ে পারব না, জনসমর্থনও তো লাগবে। আর এটি পাবো কেবল চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের যারা আছেন তাদের মাধ্যমে। এজন্য আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। আমাদের পারিবারিক এক বন্ধু ছিলেন ডা. জাফর, তিনি ছিলেন মূলত চোখের চিকিৎসক, তার মাধ্যমে আওয়ামী লীগের নেতা এম আর সিদ্দিকী সাহেব, হান্নান সাহেব, জহুর আহমেদ সাহেবদের সঙ্গে যোগাযোগ করলাম। এ সময় এম আর সিদ্দিকীকে বঙ্গবন্ধুর কাছে আমার প্রস্তুতির খবর পৌঁছে দিতে অনুরোধ করি। তারা এ বার্তা পৌঁছে দিলে বঙ্গবন্ধু প্রস্তুতি ঠিক রাখার কথা জানালেন। পরবর্তীতেও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার যোগাযোগ হতো, তবে এম আর সিদ্দিকী সাহেবের মাধ্যমে, সরাসরি যোগাযোগের কোনো সুযোগ ছিল না।
সে সময় চট্টগ্রাম সেনানিবাসে মেজর জিয়াউর রহমানসহ বেশ কয়েকজন বাঙালি সেনা কর্মকর্তা দায়িত্বপালন করছিলেন। তাদের মনোভাব কেমন ছিল?
রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের পর মনে হলো অন্য বাঙালি কর্মকর্তাদের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে হবে। সেখানে ছিল এইটথ বেঙ্গল রেজিমেন্ট, এ রেজিমেন্টে ছিল সব বাঙালি সৈন্য। অফিসারদের মধ্যে ৭০-৮০ ভাগ বাঙালি। ক্যান্টনমেন্টেই ছিল তাদের প্রশিক্ষণ সেন্টার। সেখানেও বাঙালি অফিসার বেশি। সৈনিকদেরও প্রায় সব বাঙালি। সে সময় প্রায় ১৮ শ বাঙালি সেনা হয় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, আর না হয় প্রশিক্ষক হিসেবে কাজ করছে। এছাড়াও পোস্টিংয়ে যাওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন আরো প্রায় আড়াইশ সেনা। এদের মধ্যে অফিসার ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন অলি, শমসের মবিন, লেফটেন্যান্ট খালেকুজ্জামান ও মেজর শওকত। এদের মধ্যে সিনিয়র ছিলেন জিয়াউর রহমান।
আমি মার্চের ১২ বা ১৩ তারিখে প্রথম জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করি এবং তাকে পুরো জিনিসটা বুঝিয়ে বলি। আমি তাকে বললাম, আমি একটা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছি, আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কথা হয়েছে, তিনি যেন তার সৈন্য নিয়ে চট্টগ্রাম ক্যান্টমেন্টে যান এবং সেখানে যে বাঙালি সৈন্যরা আছে তাদের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করেন, যেন সেখানে থাকা বেলুচ রেজিমেন্টকে ধ্বংস করা যায়। এতে ক্যান্টনমেন্ট আমাদের দখলে আসবে আর ২ হাজার সেনাও আমরা পাব। জিয়াউর রহমান সেদিন আর কোনো মন্তব্য করলেন না।
শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু হলো কীভাবে? অন্য বাঙালি অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাদের ভূমিকা সেখানে কেমন ছিল?
আমার প্রস্তুতি শেষ। আমার কোন প্লাটুন কোথায় অবস্থান নেবে তা চূড়ান্ত হয়েছে। সবাইকে সব কিছু বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে ছক অনুযায়ী। ২৪ মার্চ, সারা দেশে উত্তপ্ত পরিস্থিতি। আমাদের কাছে তখন পরিষ্কার স্বাধীনতা ছাড়া আমাদের আর ফেরার কোনো পথ নেই। এর মধ্যে জিয়াউর রহমান সাহেবের কাছে আরেকবার গেলাম, নাসিরাবাদ এলাকার ৩ নম্বর রোডে তার বাসায়। তাকে বললাম, আমার প্রস্তুতি শেষ। আপনাকে প্রস্তুত থাকতে হবে। ইপিআরসির একজন কর্নেল ছিলেন কর্নেল চৌধুরী, তিনি ও জিয়াউর রহমানকে নিয়ে আমি বেশ কয়েকটি গোপন বৈঠক করি।
আমি ভেবেছিলাম, যেহতু জিয়াউর রহমান একজন বাঙালি অফিসার তার উপর পাকিস্তানিরা নজর রাখতে পারে। তখন আমি রাজনৈতিক নেতাদের দিয়ে অন্য অফিসারদের খবর দিলাম। ক্যাপ্টেন অলি, খালেকুজ্জামান আমরা সব একসঙ্গে হওয়ার পর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিয়ান আলম সাহেবের বাসায় বৈঠকের সিদ্ধান্ত হলো। সেখানে তাদের সব বুঝালাম, পরিকল্পনা জানালাম। তারাও একমত হলো এবং আমরা একসঙ্গে আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিলাম।
মূলত যুদ্ধ শুরু করে দিলাম ২৪ মার্চেই। ব্রিগেডিয়ার আনসারিকে চট্টগ্রাম ব্রিগেডের দায়িত্ব সেদিন দিয়ে নিয়ে আসা হলো এবং তিনি এসেই সরাসরি চলে গেলেন বন্দর এলাকায়। নির্দেশ দিলেন যে কোনো মূল্যে সোয়াত জাহাজের অস্ত্র খালাস করতে হবে। কিন্তু শ্রমিকেরা বলছে, তারা অস্ত্র নামাবে না। তখন তারা ইপিআরের সৈন্যদের দিয়ে অস্ত্র নামানোর চেষ্টা করল। সেখানে থাকা ইপিআরের গোয়েন্দারা আমাকে জানাল, অস্ত্র নামাতে অস্বীকৃতি জানানো শ্রমিক ও ইপিআর সদস্যদের লাইন করে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। তারপর তাদের দেহ একটি গানবোটে করে গভীর সমুদ্রে ফেলে দিয়ে আসা হয়। খবর পেয়েই ধারণা করলাম আজ রাতেই হয়ত তারা গণহত্যা শুরু করবে। তখন সিদ্ধান্ত নিলাম রাতেই আমাকে আক্রমণ করতে হবে।
বিকাল সাড়ে ৪টায় রেল পাহাড়ে আমার এক আত্মীয়ের বাসায় চলে গেলাম। সেখানে একটি জাম গাছ আছে, সেটার নিচে বসে আমি জিয়া আর চৌধুরী সাহেব আগেও তিনবার মিটিং করেছি। আমরা ঠিক করেছিলাম এই রেল পাহাড়ই হবে আমার হেড কোয়ার্টার। এখান থেকে ফোনে হালি শহরে সুবেদার জয়নালকে রেডি রেখেছিলাম আগে থেকেই। তাকে বললাম কোড ম্যাসেজ দুটো এখনই পাঠিয়ে দেন। তখন টেলিফোন নাইন সব জায়গায় ছিল না, তাই ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ম্যাসেজ পাঠানো হলো।
তখন ৬টা সাড়ে ৬টা বাজে। এদিকে জিয়াউর রহমান সাহেব আমার বাসায় ফোন করলেন। আমাকে ফোনে না পেয়ে রেল পাহাড়ে আমার অবস্থানে তিনি ও কর্নেল চৌধুরী আসলেন। ওনারা প্রথমেই জানতে চাইলেন কী হচ্ছে? আমি জানালাম যা হচ্ছে। আর বললাম, আমি যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছি, তারাও যেন শুরু করেন। কারণ ওটাই আমাদের কথা ছিল। আমি যুদ্ধ শুরু করলে ওনারাও শুরু করবেন। অথবা ওনারা শুরু করলে আমি নামব।
তখন জিয়াউর রহমান ও চৌধুরী সাহেব বললেন, তুমি যে যুদ্ধ শুরু করলে আমরা তো এই মুহূর্তে নামতে পারছি না। কারণটা হলো, এখনো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের আলোচনা চলছে। আলোচনা যদি সফল হয় তাহলে আমাদের অবস্থানটা কোথায় যাবে। আমি কাউকেই দোষারোপ করব না, তাদের যুক্তি হয়ত সঠিক। কিন্তু আমি যুক্তি দিলাম, ব্যর্থ হলে আপনার-আমার অ্যাকশন নেয়ার সময় থাকবে না। ঢাকাও তাদের নিয়ন্ত্রণে, সব কিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে, আপনি আমি বাঁচতে পারব না। কাজেই আমাদের ঝুঁকি নিয়ে হলেও আজকের মধ্যেই যা করার করতে হবে। তারপরেও তারা তাদের চিন্তা ভাবনা থেকে বললেন, না আজকে রাতে করা ঠিক হবে না, আমরা এ মুহূর্তে প্রস্তুত না। আমাকে বললেন, তুমি এটা বন্ধ না রাখলে আজকে আমরা তোমার সঙ্গে জয়েন করতে পারছি না।
আমি খুব দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমি তো যুদ্ধের নির্দেশ দিয়ে ফেলেছি, দুই বার্তাই চলে গেছে, এখন বন্ধ করলেও সীমান্ত এলাকায় অ্যাকশন তো আমার সৈন্যরা নিয়ে ফেলেছে। যা হোক, আমি আবার সুবেদার জয়নালকে ফোন করে বললাম, দ্বিতীয় বার্তা স্থগিত করেন। কিন্তু প্রথম বার্তাটি রেখে দিলাম অর্থাৎ প্রারম্ভিক যে বার্তা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ কর- সেটি রেখে দিলাম। এরপর জিয়াউর রহমান সাহেবরা চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আমি তাদেরকে বললাম, আপনাদের এ ভুল সিদ্ধান্তের জন্য কিন্তু মাসুল দিতে হবে।
যা হোক, আমি কাউকে দোষারোপ করব না, তারা তাদের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে অ্যাকশন নিয়েছেন। আমি অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছি। আমার যুক্তি ছিল ঝুঁকি না নিলে আমরা বিজয়ী হতে পারব না।
এরপর আপনি পরিস্থিতি সামলালেন কীভাবে?
আমি যখন দুটো বার্তা একসঙ্গে পাঠিয়েছি তখন সীমান্তে আমার সৈন্যরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে পশ্চিমা সৈন্যদের ধ্বংস করে দিয়েছে। যাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছে তাদের তো আর জীবন ফেরত আনতে পারছি না। আমি পড়ে গেলাম গভীর দুশ্চিন্তায়। একটা বিষয় খেয়াল রাখতে হবে, আমি তখন একজন তরুণ অফিসার, কতবড় ঝুঁকি নিয়ে কাজটা করেছি। পরের দিন যদি দেখা যায় আলোচনা আরো চলছে, আর সীমান্তের এ ঘটনা কোনোভাবে পাকিস্তানিদের কাছে পৌঁছে গেলে তো আমি সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার হয়ে যাই। এরপর আমার এবং আমার বিশ্বস্ত জেসিও-এনসিওদের কোর্ট মার্শাল হবে, একদিন বা দুদিনের মধ্যেই ফায়ারিং স্কোয়াড। বাঁচার কোনো পথ নেই। ২৪ মার্চই সীমান্ত আমরা নিয়ন্ত্রণে নিয়ে ফেললাম। সেই রাত খুব দুশ্চিন্তায় কাটালাম, কোনো ঘুম হলো না। ২৫ মার্চ গেলাম অফিসে, সব সময় ভাবছি, কোনো এক সময় সীমান্ত থেকে খবর আসলেই আমি ও আমার সঙ্গের সবাই শেষ। পাশাপাশি আগামী ৫০ বছরেও এ ধরনের কোনো ব্যবস্থা বাঙালিরা নিতে পারবে না। পাকিস্তানিরা আর সে পথ রাখবে না।
২টা পর্যন্ত অফিসে ছিলাম। এরপর খাওয়া দাওয়া করতে বাসায় ফিরে গেলাম। ৪টা পর্যন্ত বাসার লনে বসে চা খাচ্ছি আর চিন্তা করছি। এমন সময় ডা. জাফর আসলেন, সঙ্গে আরেকজন আওয়ামী লীগ নেতা। আমি বললাম, ঢাকা থেকে কোনো খবর পেয়েছেন কিনা। তারা বলল, ঢাকার পরিস্থিতি খুব থমথমে। আমি বললাম, আজকের রাত খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনারা যান, ঢাকা থেকে যে কোনো খবর পাওয়া মাত্র আমাকে জানাবেন।
তারা চলে গেলেন। রাত তখন ৮টা ২০। খেতে বসেছি, এমন সময় জাফর সাহেব আবার আসলেন। দৌড়ে এসে জানালেন আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে। ইয়াহিয়া খান ও তার উপদেষ্টারা চলে গেছেন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে পশ্চিমা সেনারা তাদের সামরিক পোশাক পরে নিয়েছে, তাদের ট্যাংকগুলোতে আগে থেকেই রাবার ট্যাগ লাগানো হয়েছে। সেগুলোতে মেশিনগান বসানো হচ্ছে। সৈন্যরা অস্ত্র গোলাবারুদ নিয়ে যানবাহনে উঠেছে। এ খবর পেয়েই চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগের নেতারা গোপন বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করতে। তারা বার্তা পাঠিয়েছেন, নাউ ইট ইজ ইউর শো। আমি আর খাওয়া দাওয়া করতে পারলাম না।
তখন আমি বাসা থেকেই হালিশহরে সুবেদার জয়নালকে ফোন করলাম। বললাম, গতকাল যে বার্তাটি স্থগিত করেছিলাম সেটি আবার পাঠিয়ে দেন। হালিশহরে আমার যে ছক তৈরি করা আছে সে ছক অনুযায়ী অস্ত্রাগার আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, যানবাহনগুলো আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ওয়্যারলেস সেন্টারে পুরোটা বাঙালি অপারেটর নিয়ে রেখেছিলাম আমি। অ্যাডজুটেন্ট হওয়াতে এটা আমার সুবিধা ছিল, এ দায়িত্বগুলো আমার মতো করে ভাগ করে দিতে পারতাম। কাজেই যুদ্ধ যখন চূড়ান্তভাবে শুরু হলো হালি শহরে সব যায়গায় খালি বাঙালি সৈন্য। আমরা কৌশলে সব অবাঙালি সৈন্যদের বন্দি করলাম। হালি শহরে আমাদের হেড কোয়ার্টারে তিন চারটা বড় বড় রুমে হাত বেঁধে আটকে রাখলাম। পরবর্তীতে পাক সেনারা যখন হালি শহরে আক্রমণ করে আর্টিলারি থেকে, এমনকি নেভির ডেস্ট্রোয়ার থেকেও সেল নিক্ষেপ করা হয়। তখন তারা বন্দি থাকা পশ্চিমা সৈন্যদের মেরে ফেলে।
চূড়ান্তভাবে যুদ্ধ শুরু করলেন কবে? কীভাবে চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণে নিলেন?
পরে, পরিকল্পনা অনুযায়ী, যার যেখানে যাওয়ার কথা, অস্ত্র গোলাবারুদসহ তাদের সেখানে পাঠিয়ে দেয়া হলো। আমি আওয়ামী লীগ নেতাদের বললাম, আমাদের সেনারা যেখানে আছে তাদের জন্য খাবারের ব্যবস্থা করতে। জাফর সাহেব এবং আরো যারা ছিলেন তাদের বললাম, ষোল শহরে গিয়ে জিয়াউর রহমান সাহেবকে বলেন, আমি যুদ্ধ শুরু করেছি, তারাও যেন শুরু করেন। ওরা গিয়ে তারা জিয়াউর রহমানকে পাননি। এর মধ্যে, জিয়াউর রহমানকে তার কমান্ডিং অফিসার কর্নেল জানজুয়া সাহেব পাঠিয়েছেন সোয়াত জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাস করে নিয়ে আসার জন্য। যখন জাফর সাহেবরা জিয়াকে পেলেন না তখন ওখানে যে ডিউটি অফিসার ছিল বাঙালি, সম্ভবত অলি, তাকে বলার সঙ্গে সঙ্গে সে খালিকুজ্জামানকে একটা জিপ নিয়ে পাঠাল জিয়াউর রহমানকে ফিরিয়ে আনতে। জিয়াউর রহমান ফিরে এলেন। আমাদের পরিকল্পনা ছিল- উনি উনার সৈন্য নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের দিকে যাবেন। আমি বলেছিলাম, ক্যান্টনমেন্টের উল্টো দিকে পাহাড় ছিল। উনি ওখানে অবস্থান নিয়ে ডিফেন্স নেবেন। আর ক্যান্টনমেন্টে থাকা বেলুচ রেজিমেন্টের উপর গুলিবর্ষণ করবেন। বেলুচ রেজিমেন্ট ডিফেন্সে গেলে বেঙ্গল রেজিমেন্টকে সংগঠিত করবেন কর্নেল চৌধুরী। তারা বালুচ রেজিমেন্টকে ধ্বংস করবে, বন্দি করবে এবং তাদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফেলবে। এতে ক্যান্টনমেন্ট তাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। এ রকমই কথা ছিল।
কিন্তু জিয়াউর রহমান সাহেব কোনো অজ্ঞাত কারণে ক্যান্টনমেন্টের দিকে না গিয়ে শহর ছেড়ে চলে গেলেন কালুরঘাট রেলওয়ে ব্রিজ হয়ে কক্সবাজারের রাস্তায়। এদিকে, আমার ম্যাসেজ পেয়ে কক্সবাজার, বান্দরবান, কাপ্তাই, রাঙামাটি থেকে সৈন্যরা শহরের দিকে আসা শুরু করে। কাপ্তাই থেকে ক্যাপ্টেন হারুন তার সেনাদের নিয়ে আসার পথে দেখেন বাঙালি সৈন্যরা শহর থেকে কক্সবাজারের দিকে যাচ্ছে। তখন সে কথা বললে সৈনিকেরা তাকে জানায়, শহরে কেউ নাই। তখন ২৬ মার্চ খুব সকাল। হারুন তখন বুঝতে পারছিল না কী করবে। তখন সেও ভুলে কক্সবাজারের দিকে চলে যায়।
এদিকে কক্সবাজার থেকে যে সৈন্যরা আসছিল, সুবেদার মফিজ, গনি মিয়া ওরাও দেখে শহর থেকে চলে যাচ্ছে জিয়াউর রহমানের গ্রুপ। ওরা তো আর চেনে না। তাদেরও বলা হলো শহরে কেউ নাই। জিয়াউর রহমানের সৈন্যরা জানাল, শহর ফল করেছে। তাদেরকে আর শহরে আসতে দিলো না। বিভ্রান্ত হয়ে তারা তাদের সঙ্গেই থেকে গেল। এতে আমি হারুনের গ্রুপটাকে পেলাম না, কক্সবাজারের গ্রুপটাকে পেলাম না। রামু পর্যন্ত যাওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা তাদের বাধা দিলো, কারণ তাদের কাছে খবর ছিল আমরা এখানে যুদ্ধ করছি, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের কর্মীরা আমাদের সহায়তা করছে। তখন রামু থেকে তারা কালুরঘাট পর্যন্ত ফিরে আসে, কিন্তু শহরে না এসে ব্রিজের ওপারে অবস্থান নেয়।
এর মধ্যে, এক লোক আসেন, খন্দকার। উনি এসে আমাকে জানান, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি বললেন, কালুরঘাটে একটা রেডিও ট্রান্সমিটার আছে ওখানে গিয়ে আপনি একটু বক্তব্য রাখেন। আমি বললাম, আমি এখান থেকে চলে গেলে আমার সৈন্যরা ভাববে, আমি হয়ত হেডকোয়ার্টার ছেড়ে চলে যাচ্ছি। তখন তারাও চলে যাবে, আর বাইরে থেকে আমার সৈন্যরা আসলে আমাকে না পেলে তারাও চলে যাবে। আমি তাকে বললাম, আপনারা একটা টেপ রেকর্ডার নিয়ে আসেন, আমি বক্তব্য রেকর্ড করে দেব, আপনারা কালুরঘাট থেকে সেটা প্রচার করবেন। তারা আর ফিরতে পারেননি। কারণ পরের দিনই আমাদের উপর সেলিং শুরু হয়।
এর মধ্যে, চট্টগ্রাম টেলিফোন এক্সচেঞ্জ থেকে একজন ফোন করে আমাকে জানাল- কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাঙালি অফিসার মেজর বাহার আমাকে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে যে, সেখান থেকে ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফি তার ব্রিগেড নিয়ে চট্টগ্রাম রওনা হয়েছেন। তাদের সঙ্গে আর্টিলারি কামান আছে, মর্টার রেজিমেন্ট আছে, ইঞ্জিনিয়ার্স ব্যাটালিয়ান আছে, কমান্ডোও কিছু আছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে হালি শহরে থাকা আমার রিজার্ভ দুই কোম্পানিকে অ্যাম্বুসের জন্য পাঠালাম। ২৬ মার্চ বিকাল ৫টায় ইকবাল শফির পুরো কনভয়টা অ্যাম্বুসের মধ্যে এসে পড়ল। সম্মুখের প্রায় ১৫-২০টা গাড়ি। এখানেই ইকবাল শফি, দুই ব্যাটালিয়ন কমান্ডারসহ অফিসাররা ছিলেন। তারা ধারণাও করতে পারেনি চট্টগ্রাম আমরা টেকওভার করেছি। আমাদের পক্ষে সুবেদার মুসা তার কোম্পানি নিয়ে প্রচণ্ড মর্টার সেলিং করল, মেশিনগান ফায়ার করল, তাদের অনেকগুলো যানবাহন ধ্বংস হয়ে গেল। একজন কর্নেল, ২-৩ জন মেজর, ক্যাপ্টেনসহ বেশ কয়েকজন অফিসারসহ মোট ৭২ জনকে আমরা সেখানে ধ্বংস করতে সক্ষম হই। কাজেই চট্টগ্রাম শহরে ঢোকার তাদের যে পরিকল্পনা সেটা ব্যর্থ হয়ে যায়। আমরা যদি এই অ্যাকশনগুলো না নিতাম তাহলে হয়ত পরিস্থিতি অন্যরকম হতে পারত।
এদিকে রামগড় থেকে কুমিল্লা হয়ে আমার যে সৈন্যরা আসার কথা ছিল তারাও আসতে পারল না, কারণ পাকিস্তানিরা সেখান দিয়ে চট্টগ্রাম আসছিল। আবার ক্যান্টনমেন্টও তখন পাকিস্তানি বেলুচ রেজিমেন্ট দখলে নিয়ে নিয়েছে। সেখানে থাকা প্রায় এক হাজার বাঙালি সৈন্যকে ২৫ মার্চ রাতেই তারা হত্যা করে। কারণ বাঙালি সৈন্যদের কেউ সংগঠিত করতে পারেনি। প্রথমেই হত্যা করে কর্নেল চৌধুরীকে। কাজেই ওখানে নেতৃত্ব দেয়ার মতো আসলে কোনো অফিসার ছিল না। এটা একটা বিরাট সেটব্যাক হলো। তবে আমরা যে অবস্থানটা নিয়ে নিয়েছি, এটা সে সময় পাকিস্তানিদের জন্য বিরাট বিপর্যয় হয়ে গেল। পরে এপ্রিল-মে পর্যন্ত দুমাস চট্টগ্রাম শহর আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। মে’র ২ তারিখে, আমাদের লাস্ট হোল্ড রামগড়ে প্রচণ্ড যুদ্ধ করার পরে আমরা ভারতীয় অঞ্চলে ফলব্যাক করি। সেখানে পুনর্গঠনের কাজ চলে। অন্য জায়গাগুলোতেও কিন্তু যারা ছিলেন এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ প্রত্যেকে নিজ নিজ জায়গা থেকে অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে ভূমিকা রেখেছে। যেমন ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া এলাকায় খালেদ মোশাররফ সাহেব, শাফায়েত জামিল সাহেব তারা করেছেন। জয়দেবপুর এলাকায় শফিউল্লাহ সাহেব, কর্নেল মঈন, নর্থ বেঙ্গলে ক্যাপ্টেন নজরুল, রাজশাহীতে ক্যাপ্টেন গিয়াস তাদের সঙ্গে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। এককভাবে সব হয়নি।
রেডিওতে স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা নিয়ে একটি কথা বলছিলেন। পরে এই বার্তাটি প্রচার হলো কীভাব? কে প্রচার করল?
রাজনৈতিক নেতারা আমার কাছে টেপ নিয়ে আসতে পারল না। পরে যখন তাদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ হলো, আমি বললাম ঠিক আছে, কালুরঘাটের ওপারে বাঙালি অফিসার যাকেই পান তাকে বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। সে শুধু বলবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বাঙালি অফিসাররা জনগণের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ শুরু করেছে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। এটুকুই বলার কথা। তারা সেখানে গিয়ে পেলেন জিয়াউর রহমান সাহেবকে। তাকে নিয়ে আসলেন কালুরঘাটে, এটা হল ২৭ তারিখে। এর আগে, ২৬ মার্চ দুপুর ২টা ৪০ মিনিটের দিকে হান্নান সাহেবকে দিয়ে আমরা একটা ঘোষণা দেয়ালাম। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন, এটাও কালুরঘাট ট্রান্সমিটার থেকে। জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে গেলেন। গিয়ে তিনি এই বক্তব্য না দিয়ে, নিজেই একটা বক্তব্য দিয়ে নিজেকে হেড অব দ্য স্টেট ঘোষণা করলেন। এটা কিন্তু আমি শুনতে পাইনি, কারণ আমাদের উপর তখন সেলিং চলছে, আমরা যুদ্ধ করছি।
এ কে খান সাহেব এবং এম আর সিদ্দিকী সাহেব আমাকে ফোন করলেন। তারা বললেন যে, হু ইজ দিস মেজর জিয়া। জানালেন, জিয়ার ঘোষণার কথা। বললেন, তাহলে তো আমরা এটাতে নাই, এটা তো মিলিটারি ক্যু। আমি বললাম দেখেন, এখন ঝগড়া করার সময় না। উনি ভুল করে থাকলে সেটা শোধরানো যাবে। কী বললে ঠিক হবে, আপনারা লিখিতভাবে ওনাকে পাঠান, উনি সেটাই পড়ে শোনাবেন। তখন ঘোষণার একটি ড্রাফট তৈরি হলো। জাফর সাহেবসহ কয়েকজন দ্রুত কালুরঘাট পৌঁছে গেলেন জিয়াউর রহমান সাহেবের কাছে। ড্রাফট পাওয়ার পর ২৮ মার্চ সকালে জিয়াউর রহমান সাহেব তার আগের বক্তব্য বদলিয়ে বললেন, আমি এই ঘোষণাটা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পক্ষে দিচ্ছি। কিন্তু জিয়াউর রহমান সাহেব পরে আর শহরে যুদ্ধে আসলেন না। উনি সেখান থেকে রামগড় চলে গেলেন অন্য রাস্তা দিয়ে। আমি এগুলো জেনেছি অনেক পরে। যা হোক পরে যখন রামগড়ে আমরা উইথড্র করলাম, সেখানে যুদ্ধ হলো তখন দেখলাম, জিয়াউর রহমান সাহেব, শওকত সাহেবও পরে এসে যোগ দিলেন। যুদ্ধ করতে করতে পাকিস্তানিদের অনেক ক্ষয়ক্ষতি করে আল্টিমেটলি আমাদের ফল ব্যাক করতে হলো। কারণ আমাদের গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেছে, অস্ত্র পাচ্ছি না। সৈন্যরা ইনজিউরড হলে চিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা আমাদের তখন ছিল না। ২ মে, যুদ্ধের পর রামগড় দিয়ে ফেনী নদী পার হয়ে ভারতে চলে যাই। এরপর পাকিস্তানিরা রামগড় বাজার দখল করে ফেলে।
মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরগুলো কীভাবে ভাগ করা হলো? অন্যদের সঙ্গে আপনাদের যোগাযোগ হলো কীভাবে?
১৭ এপ্রিল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রপতি করে প্রবাসী সরকার গঠন করা হয়। এর ফলে, ভারতীয়দের সঙ্গে আলাপ আলোচনা চালাতে সুবিধা হয়। পরে, জুলাই মাসের ১০ থেকে ১৫ তারিখ সব সেক্টর কমান্ডারদের কোলকাতা নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ৪-৫ দিন ধরে আমরা রণকৌশল নির্ধারণ করি। সেক্টরগুলো ভাগ করি। কোন অঞ্চল কোন সেক্টরে থাকবে, এভাবে পুরো দেশকে ১০টি সেক্টরে ভাগ করা হয়। এক থেকে নয় এবং ১১। আর ১০ নম্বর সেক্টর ছিল বিশেষ বাহিনীগুলোর জন্য। ১৫ জুলাই থিয়েটার রোডে সব সেক্টর কমান্ডার এবং ৩টা ফোর্স কমান্ডার কে ফোর্স, এস ফোর্স, জেড ফোর্সকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি শপথ পড়ান। আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করি। এটা গুরুত্বপূর্ণ এই জন্য যে, আমরা কিন্তু মার্সিনারি আর্মি না। একটা রাজনৈতিক সরকারের অধীনে একটি নিয়মিত বাহিনী যার আন্ডারে গেরিলা ও নিয়মিত যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কোন ঘটনাটি আজও আপনাকে স্মৃতিকাতর করে?
অনেক এমন ঘটনা আছে। এপ্রিলের সম্ভবত শেষের দিকে ২১ তারিখ হবে। আমরা তখন কড়েরঘাট এলাকায় যুদ্ধ করছি। অল্প কিছু সেনা নিয়ে আমি পাকিস্তানিদের প্রতিহত করছি। পাকিস্তানিরা সেলিং করছে। আমি সামনে গিয়ে আমাদের সৈন্যদের অবস্থানগুলো দেখছি। কিছু দূরে একটা সেল পড়ল, দেখলাম দু তিনজন মহিলা সেখানে দৌড়াদৌড়ি করছে। আমি নালার ভেতর দিয়ে সেখানে গেলাম। দেখলাম, তাদের বাড়ির সামনের উঠানে একটা কিশোরী মেয়ে, দ্বিখন্ডিত দেহ। রক্তে চারপাশ ভেসে যাচ্ছে। দুজন মহিলা উদ্ভ্রান্তের মতো কাঁদছে আর দৌড়াচ্ছে। বুঝতে পারছে না কোন দিকে যাবে। সেল পড়াতে তাদের কুড়েঘরে আগুন ধরে গেছে। জানতে চাইল আমরা কারা। বললাম মা, আমরা আপনার সন্তান। এ দেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছি। ওনাদেরকে আর বেশি কিছু বলতে পারলাম না, শুধু বললাম, আপনারা নিচে নামেন।
দেখি মহিলা আর নিচে নামেন না, আকাশের দিকে হাত তুলে দোয়া করছে। মাগরিবের পর দুপক্ষের গোলাগুলিই থামলো। আমি স্থানীয় একটা স্কুলের মাঠে শুয়ে একটু বিশ্রাম করছি আর ভাবছি, এভাবে আর কতদিন চালানো যাবে। হঠাৎ কানে এলো ওই মহিলার কন্ঠ, যার কন্যা সন্তানটি সেল পড়ে মারা গেছে। সে তার ভাষায় বলছে, আল্লাহ আমার সন্তানটাকে তুই নিয়ে গেছিস আমার কোনো দুঃখ নাই। এরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করছে, আল্লাহ, তুই তাদেরকে বিজয়ী কর, তারা যেন এ দেশটাকে স্বাধীন করতে পারে। এ ঘটনাটি আমার সারা জীবন মনে থাকবে।
এমন অনেক ঘটনাই আছে, অতি সাধারণ মানুষ তাদের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান কিছু হারানোর পরেও সেটা চিন্তা না করে, আমরা যারা যুদ্ধ করছি, আল্লাহ যেন আমাদের বাঁচিয়ে রাখেন, আমরা যেন দেশ স্বাধীন করতে পারি- এই চিন্তা করেছেন। একটা জাতি যখন তার যোদ্ধাদের সঙ্গে এক হয়ে যায় তখন সে জাতি অবশ্যই বিজয়ী হয়।
আরেকটা ঘটনা বলে রাখি, অনেক যুদ্ধ করে আমরা ১৬ ডিসেম্বর ভাটিয়ারি এলাকায় আসলাম। পাকিস্তানিদের খুব শক্ত একটা ডিফেন্স ছিলো সেখানে, এটাই তাদের শেষ যুদ্ধাবস্থান। এর আগে আমরা সীতাকুণ্ডের হিলরেঞ্জের ভেতর দিয়ে ভারতীয় দুটি আর আমার মুক্তিযোদ্ধাদের একটি ব্যাটালিয়ান পাঠিয়ে দিয়েছি। তাদের লক্ষ্য ছিল ভাটিয়ারি আর শহরের মাঝামাঝি একটি জায়গায় ডিফেন্স নেবে। আর তাদের দিকে যেন পাকিস্তানিদের দৃষ্টি না যায় এজন্য আমরা পশ্চিম দিক দিয়ে আরেকটা গ্রুপ পাঠালাম। এদেরকে পাঠালাম ৩টার দিকে। আর মূল বাহিনী যাবে অন্যদিক দিয়ে। অনেক মুক্তিযোদ্ধা আমার সঙ্গে ছিল যাদের বয়স ১০, ১১, ১২ এরকম। এর মধ্যে ১২-১৩ বছরের একটা ছেলে ছিল রবিউল নাম। ওর বাড়িও ছিল সীতাকুণ্ডে। যুদ্ধের প্রথম থেকেই সে আমার সঙ্গে ছিল। সীতাকুণ্ড যখন আমরা মুক্ত করলাম, ওকে বললাম, তোমার তো বাবা মা আছে, যাও দেখা করে এস। সে বললো, না স্যার এখন যাবে না, দেশ আগে মুক্ত হোক। পশ্চিম দিক দিয়ে যে দলটিকে পাঠিয়েছিলাম সেখানে রবিউলও ছিল। সাড়ে ৪টা নাগাদ তারা পাকিস্তানিদের আক্রমণ করল। কিছুক্ষণ পরেই ওয়্যারলেসে খবর পেলাম বেশ সেলিং হয়েছে এবং আমাদের কয়েকজন শহিদ হয়েছেন, কিছু গুরুতর আহত হয়েছে। সেই কিশোরটি যে কিছুক্ষণ আগে বলল, দেশ মুক্ত না হলে বাবা-মাকে দেখবে না, পুরো যুদ্ধের ৯ মাসই সে আমাদের সঙ্গে ছিল, সেও সে সময় শহিদ হয়। এ রকম আরো অসংখ্য ঘটনা আছে। দেশের প্রত্যেক অঞ্চলে এমন অসংখ্য ঘটনা আছে। এদের কথা রেডিও টেলিভিশনে তেমন একটা আসে না। এরা না থাকলে, এদের এত আত্মত্যাগ, এত অসামান্য আবদান না থাকলে আমাদের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন করা অনেক কঠিন হতো বলে আমি মনে করি, প্রায় অসম্ভব হতো। জনগণের সমর্থন ছাড়া পৃথিবীর কোনো দেশেই কখনো স্বাধীনতার যুদ্ধ হয়নি। এটা শুধু কোনো সামরিক অভিযান নয়, এটা জনগণের যুদ্ধ এটা আমাদের মনে রাখতে হবে।
বিজয়ের সেই মুহূর্তের কথা যদি একটু বলতেন? যখন চট্টগ্রামে আসলেন কী দেখলেন?
১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ হলো, দুর্ভাগ্যক্রমে এর মাত্র ১৫ মিনিট আগে আমার এতো জন শহিদ হয়ে গেলেন, এটা আমাকে সব সময় পীড়া দেয়। যা হোক, ওই দিন রাতেই একটা ব্যাটালিয়ান পাঠিয়ে দিলাম চট্টগ্রাম শহরের দিকে। তাদের কাজ হলো সার্কিট হাউজে যেখানে আমরা বাংলাদেশের পতাকা ওড়াব, সেখানে একটা নিরাপত্তা বলয় তৈরি করা। শহরের রাস্তায় রাস্তায় অবস্থান নেয়া। যাতে পাকিস্তানের কোনো চর বা সৈন্য বিক্ষিপ্তভাবে আমাদের উপর গুলিবর্ষণ করতে না পারে। সার্কিট হাউজের সামনে গেলাম ১৭ ডিসেম্বর, সকাল তখন ৯টা বেজে যায়। এর মধ্যেই হাজার হাজার মানুষ ছুটে এসেছে, মুক্তিযোদ্ধারাও এসেছে। আনন্দ উল্লাস, এটা বর্ণনা করা খুব কঠিন, বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মতো। সার্কিট হাউজের সামনে কয়েক হাজার মানুষ মুহূর্তের মধ্যে জমে গেল। অনেকে আনন্দে জুতা স্যান্ডেল পরার কথাও ভুলে গেছে। অভূতপূর্ব সে দৃশ্য। ফ্ল্যাগ পোস্টে তখনও পাকিস্তানের পতাকা উড়ছে। সেটাকে নামিয়ে ছিড়ে ফেলা হলো। একটা ৮-৯ বছরের কিশোরকে ডাকলাম। হাতের প্যাকেটে দুটা পতাকা ছিল, সে সময়ের বাংলাদেশের পতাকা। মাঝখানে মানচিত্রের চিত্র। এটা পুরোটা সময়ই আমার সঙ্গে রেখেছিলাম, ঠিক এমনই একটা মুহূর্তের জন্য। সে পতাকা রোপে বাঁধলাম আর সেই কিশোরকে বললাম, তুমি এটা উপরে তোলো। তুলছে এবং হাজার হাজার মানুষ নিশ্চুপ হয়ে আছে। অবিস্মরণীয় সে দৃশ্য দেখছে। দীর্ঘদিন পরে স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম পতাকা উঠানো হচ্ছে। আমি সে পতাকা দেখে সেলুট দিয়ে দাঁড়ালাম। অনেকটাই স্বপ্নের মতো। ভাবতেও পারিনি মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু করে ডিসেম্বরেই দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। মানুষের সেই বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো আনন্দ উল্লাস। কিশোরটিকে দিয়ে পতাকা তোলার আমার একটা উদ্দেশ্য ছিল। এটা একটা বার্তা, ওই প্রজন্ম, আজকের প্রজন্ম এবং অনাগত ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে, যে এই পতাকার জন্য তোমাদের পূর্ব পুরুষেরা সংগ্রাম করেছে, জীবন দিয়েছে, অসামান্য আত্মত্যাগ করেছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ। তোমাদের জন্য আমরা এ পতাকা নিয়ে এসেছি, তোমরা এ পতাকার মূল্যায়ন করবে, একে রক্ষার দায়িত্ব তোমাদের কাছে।
এমন সময় একজন বয়স্ক মানুষ আমার দিকে এগিয়ে আসলেন। খুব ধীর স্থীরভাবে হেঁটে আসলেন আমার কাছে, আমি চিনি না তাকে। এসে আস্তে করে তার মাথাটা আমার বুকে রাখলেন। কিছুক্ষণ। তারপর আবার ফিরে গেলেন। একজনের কাছে জানতে চাইলাম তিনি কে। লোকটা বললো, ওনারা শুনেছেন এই ভদ্রলোকের দুটি সন্তান ছিল, দুজনই যুদ্ধে শহিদ হয়েছেন। কিন্তু তার কোনো ক্ষোভ নাই, আক্ষেপ নাই। শুধু মনে হলো আমার বুকে মাথা রেখে উনি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন, তারপর আবার চলে গেলেন।
এই মুক্তিযুদ্ধে কিন্তু জনগণের যুদ্ধ। এই পতাকা আমাদের সবার সম্মিলিত মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতীক হয়ে সেদিন বাংলার মুক্ত আকাশে উড়েছিল।