নারায়ণগঞ্জ শহরে হকার উচ্ছেদ দিয়ে মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী ও সংসদ সদস্য শামীম ওসমান সমর্থকদের মধ্যে আলোচিত সংঘর্ষের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
দুই পক্ষের সংঘর্ষে আইভীসহ অর্ধশতাধিক মানুষ আহত হওয়ার পর যে দুটি মামলা হয়েছিল, তার একটিতে কাউকে শনাক্ত করতে না পেরে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। অন্য একটি মামলার তদন্ত এখনও শেষ করা যায়নি।
ওই সংঘর্ষের সময় অস্ত্র হাতে যুবলীগ নেতার যে ছবি এসেছিল গণমাধ্যমে, সেটির লাইসেন্সের মেয়াদ পার হয়ে গিয়েছিল। সংঘর্ষে সে অস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
২০১৮ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কে ফুটপাতে হকার বসানোকে কেন্দ্র করে আইভী ও শামীম সমর্থকদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়।
এ ঘটনায় জেলা প্রশাসন যে তদন্ত কমিটি করেছিল, সেটির প্রতিবেদন আর জমা দেয়াই হয়নি। অথচ সরকারের ঘোষণা ছিল, প্রতিবেদন দেখে ব্যবস্থা নেয়ার।
তখন জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল। দফায় দফায় সময় বাড়ানোর হয় প্রতিবেদন জমা দেয়ার। পরে এক সময় কমিটির কর্মকর্তারা বদলি হয়ে যান অন্য জেলায়।
পাল্টাপাল্টি অভিযোগ ও মামলা
ঘটনার পরদিন ১৭ জানুয়ারি মেয়র আইভীর ভাই ও সমর্থকসহ ১৭ জনের নাম উল্লেখ করে থানায় অস্ত্র ছিনতাই ও হত্যাচেষ্টার লিখিত অভিযোগ দেন যুবলীগ নেতা নিয়াজুল ইসলাম, যার হাতে অস্ত্রসহ ছবি প্রকাশ হয় গণমাধ্যমে।
অন্যদিকে আইভীকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ এনে ২২ জানুয়ারি নিয়াজুলসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও এক হাজার জনকে আসামি করে থানায় অভিযোগ দেন সিটি করপোরেশনের আইন কর্মকর্তা জিএম সাত্তার।
তবে পুলিশ অভিযোগ দুটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) হিসেবে রেকর্ড করে। ২২ মাস ১৮ দিন পর ২০১৯ সালের ৪ ডিসেম্বর উচ্চ আদালতের নির্দেশে সদর মডেল থানায় দেয়া অভিযোগটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করা হয়।
মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, জখম, নাশকতা, ভাঙচুরসহ অরাজকতার অভিযোগ আনা হয়।
আরও এক মাস পর পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশে তদন্তে নামে পুলিশ ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)।
তদন্তের অগ্রগতি নিয়ে জানতে চাইলে তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) টিপু সুলতান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তদন্ত চলছে। ঘটনার সময়ের বিভিন্ন তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। একই সঙ্গে প্রত্যক্ষদর্শী, ঘটনার সাক্ষী ও আহত ব্যক্তিদের সাক্ষ্য নেয়া হচ্ছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আদালতে মামলার অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।’
মামলার আসামি নয় জন। তারা হলেন অস্ত্র প্রদর্শনকারী নিয়াজুল ইসলাম খান, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম, সাংগঠনিক সম্পাদক জাকিরুল আলম হেলাল, মহানগর যুবলীগের সভাপতি শাহাদাৎ হোসেন সাজনু, জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি জুয়েল হোসেন, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা জানে আলম বিপ্লব, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন, যুবলীগকর্মী নাসির উদ্দিন ওরফে টুন্ডা নাসির, যুবলীগ নেতা চঞ্চল মাহমুদ।
আইভীর পক্ষে মামলার কয়েক দিন পর এক অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম শামীম ওসমান বলেন, ‘এই মামলায় আমার কোনো কর্মীকে গ্রেফতার বা হয়রানি করা হলে নারায়ণগঞ্জ অশান্ত হয়ে উঠবে।’
অভিযুক্তদের গ্রেফতার নিয়ে নারায়ণগঞ্জ পিবিআইয়ের পুলিশ সুপার মনিরুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আইভীকে হত্যার চেষ্টার মামলাটির তদন্ত চলছে। তদন্তে যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাদের গ্রেফতার করা হবে।’
মেয়র আইভীর ওপর হামলার মামলার বাদী নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের ভারপ্রাপ্ত আইন কর্মকর্তা জি এম এ সাত্তার বলেন, ‘সাংসদ শামীম ওসমানের ইন্ধনে ও প্রচারণাতেই মেয়র আইভীর ওপর হামলার ঘটনা ঘটে এবং তাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়।’
সন্ত্রাস নির্মূল ত্বকী মঞ্চের আহ্বায়ক রফিউর রাব্বি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সড়কে প্রকাশ্যে মেয়রের ওপর অস্ত্রসহ হামলা করেছে নিয়াজুলসহ আরও অনেকে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংঘর্ষের ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে।
‘কিন্তু পুলিশ ঘটনার সাথে জড়িতদের পায় না। প্রশাসন অপরাধীদের আড়াল করতে চায়। এতে অপরাধীরা আরও উৎসাহিত হয়ে উঠছে।’
তবে শামীম ওসমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী ও মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শাহ নিজাম পুলিশের ভূমিকায় খুশি। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পুলিশ তাদের তদন্তে সত্য প্রকাশ করেছে। তবে মেয়র আইভী অন্য কাউকে দেখানোর জন্য তার কর্মকর্তাকে দিয়ে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের নামে আরেকটি মামলা করেছে, যা শামীম ওসমানকে উদ্দেশ্য করে। আশা করি, সেটিতেও পুলিশ ফাইনাল রিপোর্ট দেবে।’
পুলিশের মামলায় কেউ শনাক্ত হয়নি
মেয়র আইভী ও সাংসদ শামীম ওসমান সমর্থকদের সংঘর্ষের ঘটনার আট দিন পর ২৪ জানুয়ারি রাতে আরেকটি মামলা করেছিলেন নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানার পরিদর্শক (অপারেশন) জয়নাল আবেদীন।
ওই মামলায় পুলিশের কাজে বাধা ও হামলার অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৪০০ থেকে ৫০০ জনকে আসামি করা হয়।
মামলার তদন্ত করেন পুলিশ পরিদর্শক মিজানুর রহমান। সদর থানার রেজিস্ট্রারে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৯ আগস্ট তিনি আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) দাখিল করেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ঘটনা সত্য। তবে ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।
২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর মামলাটি নিষ্পত্তি করা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে রেজিস্ট্রারে।
পিস্তলধারী নিয়াজুল ধরাছোঁয়ার বাইরে
চাষাড়ায় সেই সংঘর্ষে মেয়র আইভী ও তার সমর্থকদের ওপর হামলার সময় পিস্তল উঁচিয়ে ধরেছিলেন যুবলীগের নেতা নিয়াজুল ইসলাম খান। ঘটনার পরদিন সন্ধ্যায় সেই পিস্তলটি পরিত্যক্ত অবস্থায় উদ্ধার করে হেফাজতে নেয় পুলিশ।
২০১৯ সালের জানুয়ারির শুরুতে ওই পিস্তলের লাইসেন্স নবায়নের জন্য আবেদন করেন নিয়াজুল। ২২ জানুয়ারি জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাব্বী মিয়া স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নিয়াজুলের পিস্তলের লাইসেন্স নবায়নের বিষয়ে আইনি মতামত জানতে চাওয়া হয়। পরে নারায়ণগঞ্জ সদর মডেল থানা ও ফতুল্লা মডেল থানা পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।
তদন্তে বলা হয়, নিয়াজুল ইসলামের অস্ত্র নবায়ন করা হলে যেকোনো সময় লাইসেন্সধারী অস্ত্র দিয়ে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে। আগ্নেয়াস্ত্র শাখা থেকে ইস্যু করা পিস্তলটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত নবায়ন করা ছিল।
পুলিশের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা নারায়ণগঞ্জ সদর থানার সাবেক পরির্দশক (বর্তমান ঝিনাইদহ সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) মিজানুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করব না।’
পুলিশ সুপার জায়েদুল আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওই ঘটনার সময় আমি এই জেলায় ছিলাম না। পুলিশ দেয়া প্রতিবেদনের সময়ও ছিলাম না। তবে যদি তদন্তে কারও গাফলতি থাকে তাহলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
কেউ মেনে নেবে না: আইভী
তার করা মামলার তদন্তে বিলম্ব আর পুলিশের নিজের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেয়ায় ক্ষুব্ধ মেয়র আইভী।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘ওই দিনের ঘটনা সারা দেশের মানুষ দেখেছে। কারা কারো জড়িত তাদের ছবি, ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
‘পুলিশ জড়িতদের খুঁজে পায় না, এটা হাস্যকর। পুলিশের মামলায় এই চূড়ান্ত প্রতিবেদন (এফআরটি) নারায়ণগঞ্জের মানুষ মেনে নেবে না।’
এ বিষয়ে শামীম ওসমানের মন্তব্য পাওয়া যায়নি তিনি ফোন না ধরায়। তার ঘনিষ্ঠ একজন নেতা জানান, সংসদ সদস্য বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ নেই।