রাজধানীর গণপরিবহনে শৃঙ্খলা আনতে নির্দিষ্ট রুটে নির্দিষ্ট রঙের বাস নামানোর উদ্যোগ এখনও আটকে আছে পরিকল্পনার মধ্যেই।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ ৪২টি সমন্বিত রুটের খসড়া তৈরি করলেও এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেননি বাস মালিকেরা। নেয়া হয়নি শ্রমিকদের মতামত।
কবে নাগাদ রুটভিত্তিক নির্দিষ্ট কোম্পানির বাস চলবে, সে ধরনের কোনো লক্ষ্যও ঠিক করা হয়নি। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরির কাজেও হাত দেয়নি কর্তৃপক্ষ।
২০১৬ সালের শুরুতে রুট সংখ্যা কমিয়ে পাঁচটি রুটে পাঁচ রঙের বাস নামানোর উদ্যোগ নেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের প্রয়াত মেয়র আনিসুল হক। দেড় বছরের মধ্যে নতুন তিন হাজার বাস নামানোর ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি।
তবে ২০১৭ সালের ৩০ নভেম্বর আনিসুল হকের মৃত্যুর পর থেমে যায় প্রকল্প।
তবে সম্প্রতি দুই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে নভেম্বরে মাঝামাঝিতে বাস মালিক, ঢাকা মহানগর পুলিশ ও নগর পরিবহন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বৈঠক করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস ও উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল হক।
বৈঠকে ঢাকায় ২৯১টি রুট থেকে কমিয়ে ৪২টি রুটের প্রস্তাব করা হয়, যেখানে ২ হাজার ৫০০ বাস মালিক থাকবেন ২২টি কোম্পানির অধীনে। এই ৪২ রুটে থাকবে ছয়টি রঙের বাস।
নগর কর্তৃপক্ষ মনে করছে, এ পদ্ধতি শুরু করা গেলে বাসগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা থাকবে না এবং শৃঙ্খলার মধ্যে আসবে শহরের পরিবহন ব্যবস্থা।
কী আছে নতুন পরিকল্পনায়
২০১৮ সালের ৯ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকায় বাস রুট পুনর্বিন্যাস ও কোম্পানির মাধ্যমে বাস পরিচালনা পরিকল্পনা তৈরির জন্য ১০ সদস্যের কমিটি করা হয়। দুই বছরের বেশি সমীক্ষা চালিয়ে গত ১০ নভেম্বর প্রতিবেদন দিয়েছে এ কমিটি।
নতুন পরিকল্পনায় ঢাকা মহানগরীতে বর্তমানে চলাচলরত আড়াই হাজার কোম্পানির প্রায় ৩০ হাজার বাসের পরিবর্তে ৯ হাজার ২৭টি গণপরিবহন চালানোর প্রস্তাব করা হয়।
ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ) জানায়, এখন মোট ২৯১টি রুট রয়েছে, যা কমিয়ে ৪২টিতে নিয়ে আসা হবে। বিদ্যমান বাসগুলো মূল্যায়নের মাধ্যমে কোম্পানিভিত্তিক মালিকানার ভাগ নির্ধারণ করা হবে।
এসব বাস ও মিনিবাস নষ্ট হয়ে গেলে মালিককে ক্ষতিপূরণ দেবে সরকার। এ ছাড়া নতুন বাস সংগ্রহের জন্য ৪-৫ শতাংশ সুদে ঋণ দেয়া হবে।
দুই থেকে তিনটি রুটকে কমিয়ে একটি করার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। নতুন রুটে কোনো ওভারল্যাপিং থাকবে না।
যেসব রুটে কোনো মালিকের ৫০০-এর বেশি গাড়ি আছে, ওই রুটে তিনিই কোম্পানির নেতৃত্বে থাকবেন। কোম্পানি নিয়ন্ত্রণের জন্য থাকবে রেগুলেটরি বোর্ড।
বাসের রং ও রুট সংখ্যা
ডিটিসিএ সূত্র জানায়, প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় প্রত্যেক রুটে চলাচলকারী বাসের নির্দিষ্ট রং থাকবে।
এর মধ্যে গোলাপি রঙের ৮৮৩টি বাস ১ থেকে ৪ নম্বর রুটে চলাচল করবে। বর্তমানের ২৯১টি রুটের মধ্যে ২৩টি রুটকে ভেঙে এই চারটি রুট করা হবে।
নীল রঙের এক হাজার ৪৩৩টি বাস ৫ থেকে ৮ নম্বর রুটে চলাচল করবে। পুরনো ২১টি রুট ভেঙে তৈরি হবে এই চারটি রুট।
মেরুন রঙের এক হাজার ১০৮টি বাস ৯ থেকে ১৩ নম্বর রুটে চলবে। পুরনো ৩৫টি রুট ভেঙে এই পাঁচটি রুট করা হবে।
কমলা রঙের এক হাজার ১২২টি বাস ১৪ থেকে ২০ নম্বর রুটে চলবে। এখনকার ৪৭টি রুট ভেঙে করা হবে সাতটি রুট।
সবুজ রঙের এক হাজার ৪৩৩টি বাস ২১ থেকে ২৮ নম্বর রুটে চলবে। পুরনো ৫৪টি রুট ভেঙে এই আটটি রুট করা হবে।
বেগুনি রঙের এক হাজার ৮৯টি বাস ২৯ থেকে ৩৪ নম্বর রুটে চলবে। পুরনো ৩৩টি রুট ভেঙে এই ছয়টি রুট করার পরিকল্পনা রয়েছে।
এ ছাড়া আলাদাভাবে উত্তর অংশে তিনটি রুট, উত্তর–পশ্চিমে তিনটি রুট ও দক্ষিণের আওতায় দুটি রুট থাকবে। বর্তমানে রাজধানীতে ঢাকা চাকা ও গুলশান চাকা নামে তিনটি রুটে চলচলকারি বাস থাকবে আগামীতেও।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার বাইরে সাব-আরবান রুটের দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ২৭১.২৩ কিলোমিটার। এই রুটগুলো থেকে ঢাকা মহানগরী পর্যন্ত গাড়ি যাতায়াত করবে।
এসব রুটের গাড়ি ঢাকায় ঢুকতে পারবে না। ঢাকা মহানগরীর সঙ্গে যুক্ত এমন নয়টি স্থানে সাব স্টেশন তৈরির প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এগুলো হলো ঝিলমিল, কাচপুর, ঘাটারচর, আব্দুল্লাহপুর, হেমায়েতপুর, কেরানীগঞ্জ, কামারপাড়া, দোহার চৌরাস্তা ও মেঘনাঘাট।
পরিকল্পনা অনুযায়ী, বাস চালক ও সহকারীদের মাসভিত্তিক বেতন দেবে কোম্পানি।
যাত্রীদের টিকিট নিয়ে যাতায়াত করতে হবে। এ ছাড়া স্মার্ট টিকিট বা ই-টিকিটিং পদ্ধতি চালুও পরিকল্পনা করা হয়েছে। এতে যাত্রীরা এককালীন কার্ডে টাকা রিচার্জ করে রাখতে পারবে।
বাস্তবায়নের কী উদ্যোগ
বড় আকারে পরিকল্পনা করা হলেও এখনও সেটি খসড়াতেই আটকে আছে। বাস মালিকেরা বলছেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। আর শ্রমিকদের দাবি, তাদের কোনো মতামতই নেয়া হয়নি।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা কোম্পানির ব্যাপারে এখনও চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেইনি। এই মাসের (ডিসেম্বর) ৮ তারিখে মেয়র মহোদয়দের উপস্থিতিতে একটা মিটিং হবে। সেখানে আমরা কোম্পানির বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেব।’
এনায়েত উল্লাহ বলেন, ‘যেহেতু এখনও কোম্পানি নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি তাই আমি এ বিষয়ে কিছু বলতে চাই না। ৮ তারিখের সভায় সব পক্ষের উপস্থিতিতে বিষয়টি তুলে ধরা হবে।’
অন্যদিকে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. হানিফ খোকন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন এই পরিকল্পনা অনেকটা একপাক্ষিক হয়ে গেছে। এখানে শুধু মালিকদের কথা শোনা হচ্ছে। আমরা যারা শ্রমিক আছি তাদের নিয়ে আলোচনা হয়নি।
‘আমরা চাই গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফিরে আসুক, তবে শ্রমিকদের বেতন যেন সরকার নির্ধারিত কাঠামোর আওতায় আনা হয়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শ্রমিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মালিক জানাইল যে তোমাগো কোম্পানির আন্ডারে নেয়া হবে। কিসের কোম্পানি আর কার কোম্পানি তা আমাগো কয় নাই। আমাদের তো টার্গেট নিয়ে রাস্তায় চলন লাগে। তারা (মালিক) তো তাগো স্বার্থ ছাড়া কিছু বোঝে না।’
ডিটিসিএর ট্রাফিক ইঞ্জিনিয়ার আনিসুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘নতুন করে ৪২টি রুটের একটা ড্রাফট তৈরি করা হয়েছে। মেয়রের (ফজলে নূর তাপস) নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি কমিটি করা হয়েছে। তারা একটি রোডম্যাপ করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে এখনও কোনো চূড়ান্ত বাজেট বা সময় নির্ধারণ করা হয়নি।’
আনিসুর রহমান বলেন, ‘আমাদের আগে ঢাকার চারপাশে নতুন করে বাস টার্মিনাল তৈরি করতে হবে। নতুন ১০টি টার্মিনাল হবে, সেখান থেকেই বাসের রুট নির্ধারিত হবে।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. শফিক-উর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা অনেক বড় একটা পরিকল্পনা। তবে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের অনেক ছোট ছোট বিষয় মাথায় রেখে আগাতে হবে।
‘মূলত কোম্পানি গঠনের ক্ষেত্রে একটা বড় বাধা আসতে পারে। ঢাকায় এখন অনেক মালিকের গাড়ির সংখ্যা দুইটা বা তিনটা। সে ক্ষেত্রে তারা একটি নির্দিষ্ট কোম্পানিতে আসার চিন্তা করতে চাইবে না। তাই তাদের কী ধরনের সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে সেটা আলোচনা করে নির্ধারণ করতে হবে।’
এই পরিবহন বিশেষজ্ঞ মনে করেন, ফ্রাঞ্চাইজি পদ্ধতিতে এ বাসগুলো পরিচালনা করার জন্য সবচেয়ে বড় বিষয় তত্ত্বাবধায়নের দিকে ভালোভাবে নজর দেয়া ও সঠিক নীতি নির্ধারণ ঠিক করা। আমাদের দেশে এই দুইটা বিষয়ের বেশি ঘাটতি রয়েছে।