রাতের শান্ত পরিবেশ ভোরের আলো না ফুটতেই কিচিরমিচির শব্দে আকাশ ভারী হতে থাকে। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখির আনাগোনা শুরু হয় আকাশজুড়ে; দলবেঁধে উড়ে বেড়ায় দিগ্বিদিক। সবুজ বৃক্ষরাজির ফাঁক গলে উঁকি দেয় সূয্যি মামা। আলোর দেখা মিলতেই লেকের পানিতে নেমে আসে হাজারো পরিযায়ী পাখি।
লাল টকটকে শাপলার মাঝে শুরু হয় পাখিদের খুঁনসুটি। সূর্যের আলোর স্নিগ্ধতার সঙ্গে পাখিদের ডুবসাঁতার প্রকৃতিতে আনে মুগ্ধতা।
ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকে এখন পরিযায়ী পাখিদের এমন আনাগোনা। অবশ্য এই আনাগোনা নতুন নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরা জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি বছর শীতে পরিযায়ী পাখিদের আগমন সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ।
এই সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকগুলোতে ফোটা লাল শাপলা আর পাখিদের আগমন নতুন রূপ দেয়। তাইতো দূরদূরান্ত থেকে ক্যাম্পাসে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা। উপভোগ করেন প্রকৃতির নয়নাভিরাম এই দৃশ্য।
প্রতি বছর কিছুটা দেরি হলেও চলতি বছর শীত শুরুর আগেই ক্যাম্পাসে পরিযায়ী পাখিদের সমাগম হয়েছে। করোনা প্রাদুর্ভাবে কয়েক মাস ধরেই ক্যাম্পাসে প্রবেশে কড়াকড়ি। তাই জনসমাগম কম থাকায় অন্য বছরের তুলনায় অতিথি পাখির সংখ্যা তুলনামূলক বেশি বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জাবিতে অতিথি পাখিদের মধ্যে অন্যতম হলো সরাল, পিচার্ড, গার্গেনি, মুরগ্যাধি, মানিকজোড়, কলাই, নাকতা, জলপিপি, ফ্লাইপেচার, কোম্বডাক, পাতারি, চিতাটুপি, লাল গুড়গুটি ইত্যাদি। ১৯৮৬ সালে সর্বপ্রথম এই ক্যাম্পাসে অতিথি পাখি আসে। তখন ৯৮ প্রজাতির পাখি দেখা গেলেও বর্তমানে ১৯৫ প্রজাতির পাখির দেখা মেলে। এর মধ্যে ১২৬টি দেশীয় প্রজাতির ও ৬৯টি বিদেশি। এদের বেশির ভাগই হাঁস জাতীয় পাখি। ক্যাম্পাসে যে পাখি আসে তার ৯৮ শতাংশই ছোট সরালি। আর বাকি ২ শতাংশ অন্য প্রজাতির পাখি।
বিশ্ববিদ্যালয়টির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ইমন মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় আসলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের লীলাভূমি। শীতকাল হলে যখন পাখিরা আসে তখন পরিবেশটা অনেক মনোরম হয়ে ওঠে। আমাদের খুব ভালো লাগে। ট্রান্সপোর্টের ওই দিকটায় পাখি বেশি থাকে। এ বছর করোনার কারণে ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় আমরা সহপাঠীরা সবাই মিলে পাখিদের জলকেলি উপভোগ করতে পারছি না।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. কামরুল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ বছর হাঁস জাতীয় নয় প্রজাতির পাখি ক্যাম্পাসে এসেছে। অন্যান্য বছর চার থেকে পাঁচ প্রজাতির দেখা যায়। ক্যাম্পাস বন্ধ থাকায় দর্শনার্থী নেই। তাই কোলাহল কম থাকায় পাখির সংখ্যা বেশি।’
তবে সবসময় পাখিদের অভয়াশ্রম নিশ্চিত করতে নিরাপত্তা জোরদার করার পরামর্শ দেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অফিসের এস্টেট শাখার অধীনে জলাশয়গুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও অতিথি পাখির নিরাপদ আবাস ব্যবস্থাপনার কাজ করা হয়।
এস্টেট শাখার আবদুর রহমান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট-বড় ২৫ থেকে ২৬টি লেক থাকলেও পাখি দুটি লেকে বেশি আসে। এমএইচ হল ও বিশমাইল এলাকার লেকটিতেও পাখিরা বসে। অতিথি পাখিদের নিরাপদ বিচরণ ও বাসস্থানের জন্য আমরা জলাশয়গুলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ উল হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শিক্ষা ও গবেষণার পাশাপাশি অনন্য কিছু বৈশিষ্ট জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রতি বছরই এখানে বিভিন্ন দেশ থেকে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি আসে। এ বছরও এসেছে।’
দীর্ঘদিন বিশ্ববিদ্যালয় ও হলগুলো বন্ধ থাকায় কোলাহল নেই, তাই পাখিও বেশি এবং আগাম এসেছে বলে জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘পাখিদের অভয়ারণ্য তৈরির জন্য যে লেগুলোতে পাখি বসে সেই লেকগুলো কখনই আমরা লিজ দেই না বা মাছ চাষ করি না। প্রাকৃতিক পরিবেশটা আমার রাখার চেষ্টা করি। এখানে যদি মাছ চাষ করা হয় তাহলে রাসায়নিক প্রয়োগের কারণে পানিটা তাদের উপযোগী থাকে না।’
বিভিন্ন স্থানে সচেতনতামূলক পোস্টারে লেখনীর মাধ্যমে পাখিদের অভয়াশ্রম নিশ্চিত করার চেষ্টা করেছে প্রশাসন।
দর্শনার্থীরা যাতে লেকের কাছে গিয়ে পাখিদের বিরক্ত করতে না পারে সে জন্য কাঁটাতারের বেড়াও দেয়া হয়েছে লেকে। এ ছাড়া লেকের পাশে ট্রান্সপোর্টটি সরিয়ে অনেক দূরে বিশমাইল এলাকায় নেয়া হয়েছে বলেও জানান ফিরোজ উল হাসান।