বাজারে আছে চিকন, মোটা দুই ধরনের চাল। আগের দিনে মোটা চালের ভাতের কদর ছিল মধ্যবিত্তের ঘরে। তবে দিন বদলে মোটার জায়গা দখল করে নিচ্ছে চিকন চাল।
অটোমেটিক মেশিনের চাল দেখতে সুন্দর সরু-ঝরঝরে, না বেছেই সহজে চড়িয়ে দেয়া যায় চুলায়। আর হাসকিং মিলের চাল মোটা, গায়ে খানিকটা লালচে আথবা কালো আভা। থাকতে পারে কাকরের মিশেলও।
বিশেষজ্ঞদের মত, চালের উপরিভাগের আবরণেই প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল বেশি থাকে। আর পুরো চালেই থাকে কার্বোহাইড্রেট। চাল সরু করতে উপরের আবরণ তুলে ফেলায় হারিয়ে যায় প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল।
প্রচলিত আছে, মোটা চাল মেশিনে কেটে তৈরি করা হয় সরু চাল। সেটা কতটা ঠিক- জানার চেষ্টা করেছে নিউজবাংলা। কুষ্টিয়ার মিল মালিক, পাইকারি বিক্রেতা ও ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে চালের নানান রকমফের।
কুষ্টিয়ার খাজানগরে রয়েছে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম চালের মোকাম (উৎপাদন ও পাইকারি বিক্রয়কেন্দ্র)। এখানে প্রায় দুই হাজার চাতাল (ধান সিদ্ধ করে শুকিয়ে প্রস্তুত করা হয় যেখানে) রয়েছে। আর হাসকিং মিল (ধান ভাঙানোর ছোট মিল) আছে পাঁচ শতাধিক। বড় অটো রাইস মিল রয়েছে ৩৩টি। এখান থেকে প্রতিদিন গড়ে তিন শ’ ট্রাক চাল সরবরাহ হয় সারাদেশে।
খাজানগরে নিজের চালকলে কথা হয় বাংলাদেশ অটো রাইস মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কুষ্টিয়া জেলা সাধারণ সম্পাদক ও ফোর স্টার রাইস মিলের মালিক মো. মফিজুল ইসলামের সঙ্গে।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে ধারণা রয়েছে মোটা চাল কেটে ছোট করা হয়। আমরা মিডিয়াতেও তেমনি দেখি। কিন্তু আমার জানামতে এমন কোনো মেশিন নেই যাতে মোটা চাল কেটে চিকন করা যায় বা চিকন চাল কেটে আরো সরু করা হয়।’
মফিজুল ইসলাম বলছেন, ‘ময়লা কাপড় পরিষ্কার করলে যেমন পাতলা মনে হয়, তেমনি চাল পলিশ মেশিনে দিলে জামার মতোই পাতলা হয়। একসময়ে ঢেকিছাঁটা চাল খেত মানুষ। সেই চালেও ওপর ময়লাজাতীয় একটা বাদামি আবরণ থাকত। এরপরে এলো হাসকিং মিল। এতে চাল পরিষ্কার হতো। এই চালটি অটোমেটিক কালার সর্টার মেশিনে দিলে আরো পরিষ্কার হয় ও পাতলা হয়ে যায়। চালটি দেখতে বেশ চকচক হয়। এই চাল দেখেই মানুষ ধারণা করে চাল কেটে সরু করা হয়েছে।’
মফিজুল ইসলাম আরও বলেন, ‘আগে ঢেকিছাঁটা চালে ভাত রান্নার সময় মাড় হতো। এখন হয় না, কারণ যা থেকে মাড় হবে সগুলো পলিশ মেশিনে বের হয়ে যাচ্ছে। গুড়া আকারের এই অবশেষ থেকে এখন তৈরি হয় রাইস ব্র্যান্ড অয়েল। এ দিয়ে মাছ ও গবাদি পশুর খাবারও তৈরি হচ্ছে।’
মিল মালিক হলেও চালের উপরের আবরণ তুলে ফেলা একদম পছন্দ নয় মফিজুলের। তিনি মনে করেন, এতে চালের ভিটামিন বের হয়ে যাচ্ছে। মানুষ পুষ্টির পরিবর্তে এখন চালের চেহারাকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে- এমন আক্ষেপও আছে তার।
খাজানগরে কুমিল্লা হাসকিং মিলের মালিক মো. হান্নান হাতেকলমে দেখালেন চালের চেহারা বদলের পদ্ধতি।
মিল থেকে সাধারণভাবে ভাঙানো চাল বের করে হাতের ওপরে রেখে বৃদ্ধাঙুলি চাপ দিতেই অনেকটা পরিষ্কার ও চেকনাই চেহারা পেল সেই চাল। হান্নান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেশিনে এভাবে নিখুঁতভাবে চাল পরিষ্কার করে পলিশ করা হয়।’
চাল পলিশ করার কৌশল দেখাতে হান্নান নিয়ে যান পাশের একটি অটোমেটিক কালার সর্টার মেশিনের কাছে।
একেকটি মেশিন মানে বিশাল কারখানা। মেঝেতে নির্দিষ্ট জায়গায় ঢালা হচ্ছে সাধারণ চাল। তা মেশিনের সাহায্যে তুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে প্রায় চার তলা উপরে। সেখানে পানি মিশিয়ে চাপ এবং তাপ দিয়ে চালের উপরিভাগের আবরণ তুলে ফেলা হচ্ছে। এরপর ওই চাল যাচ্ছে অটোমেটিক কালার সর্টার মেশিনে।
একেকটি মেশিনে সেট করা আছে অর্ধশতাধিক ক্যামেরা। কম্পিউটারাইজড সেই ক্যামেরা বাছাই করছে বিভিন্ন রঙের চাল, যেগুলো বের হচ্ছে আলাদা আলাদা পথে। কোনো পথ দিয়ে বের হচ্ছে কালো-বিবর্ণ চাল, কোনোটিতে কাকরের টুকরো। আবার গুড়ো বা চালের ভাঙা অংশ বের হয় আরেকটি পথ দিয়ে। একটি পথে বের হচ্ছে সরু চকচকে চাল।
হান্নান জানান, চাল আগে পরিষ্কার চকচকে করা না হলে কালার সর্টার মেশিন ভালোভাবে শনাক্ত করতে পারে না। তাই আগে মেশিনে চাপ দিয়ে সেটাকে পলিশ করা হয়। এভাবে চিকন হয়ে যায় চাল। আলাদা করে কেটে চিকন করার কোনো মেশিন নেই।
রোজ এন্টারপ্রাইজের মালিক মো. রফিকুল ইসলামও বলছেন, চাল কেটে সরু করার ধারণা ভিত্তিহীন।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চালে কালো দানা, মাছি (যেসব চালের এক অংশ সাদা, অন্য পাশ মাছির মতো কালো), খুদ (চালের খণ্ডিত অংশ) থাকলে সেটা এখন আর কেউ কিনতে চান না। তাই আমাদের অটোমেটিক মেশিনে বাছাই করতে হয়। এতে চালের উপরের আবরণ উঠে যায়।’
রফিকুল বলেন, ‘অটোমেটিক ড্রায়ার রাইস মিলে একবারে ধান দিয়ে দেয়া হয়। সেগুলো সিদ্ধ হয়ে কালার সর্টার মেশিনের মধ্য দিয়ে ঝকঝকে চাল বের হয়ে আসে। আবার হাসকিং মিলের চালও কালার সর্টারে দিয়ে চকচকে করা হচ্ছে।’
চাল দেখে বোঝার উপায় বাতলে দিয়ে তিনি বলেন, ‘হাসকিং চালের মধ্যে তিন প্রকারের ময়লা (আবরণযুক্ত) চাল থাকে। মাছি থাকে, লালচে থাকে, পাথর ও কাটা দানা থাকে। আর অটোর চাল একবারে চকচকে। এসব কিছুই থাকবে না।’
মিল মালিক ছাড়াও নিউজবাংলা কথা বলেছে চালের পাইকারি ব্যবসায়ীদের সঙ্গে।
কুষ্টিয়া শহরের বড়বাজারের মেসার্স বাঁধন ট্রেডার্সের মালিক আব্দুল হামিদের বলেন, ‘আমাদের কাছে সব ধরনের চালই আসে, তবে অটো ড্রায়ার মেশিনের চালের চাহিদা বেশি। অটো মিলের চাল সাধারণত পিচ্ছিল এবং সফট্ হয়। ক্রিম কালারের হয়। আর হাসকিং মিলের চাল সাদা বর্ণের, হাতে নিলে একটু রুক্ষ মনে হয়।’
বাজারের প্রবীণ ব্যবসায়ী শিব বাবু ৩৮ বছর ধরে চালের ব্যবসা করছেন। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অটো মেশিনের পলিশ চাল যেটা সাধারণত মিনিকেট নামে বিক্রি হয়, সেটা দেখতে চকচকে-ঝকঝকে। এটা ইচ্ছা করলে ক্রিম কালার করা যায়, আবার সাদাও করা যায়। মেশিনে যেমন কমান্ড দেবেন তেমনি চাল বের হবে।’
অটোমিলের চালের দিকেই এখন ক্রেতার ঝোঁক বেশি বলে জানালেন শিব বাবুও। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘কেউই এখন আর বাড়িতে নিয়ে চাল ঝেড়ে বা বেছে ভাত রাঁধতে চান না। কিন্তু অ-বাছাই হাসকিং মিলের চালের ভাত সুস্বাদু, মিষ্টি হয়ে থাকে।’
কোন চালের পুষ্টিগুণ কেমন- জানতে নিউজবাংলা কথা বলেছে কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাপ্লাইড নিউট্রিশন অ্যান্ড ফুড টেকনোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান ড. মো. আবুল কাশেম তালুকদারের সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘চালের উপরিভাগের আবরণে কার্বোইড্রেটের সঙ্গে প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। এই আবরণ ছেঁটে ফেললে শুধু কার্বোহাইড্রেটই পাওয়া যাবে, বাকি পুষ্টি থাকবে না।’
বাজার থেকে জনপ্রিয় আটটি ব্র্যান্ডের মিনিকেট নামের চালের নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করেছেন আবুল কাশেম তালুকদার। জানালেন, ‘স্বাভাবিক চাল থেকে ফ্যাট ও ভিটামিন বি-২সহ যেসব খাদ্য ক্যালোরি পাওয়ার কথা, বাজারে বিক্রি হওয়া মিনিকেটে তার কিছুই নেই।’
তিনি বলেন, ‘তিন দশক আগেও ঢেকিছাঁটা চালের সঙ্গে হাসকিং মিলের চালের তুলনা করা হতো। তখনই ঢেকিছাঁটা চাল অর্থাৎ বাদামি আবরণের চাল খাওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী করা হতো। এখন চাল ছেটে ছোট করা হচ্ছে। এগুলো খেয়ে আমরা অনেক পুষ্টি উপাদান হারাচ্ছি।’
মিনিকেট নিয়ে বিভ্রান্তি
বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের মিনিকেট চালের দেখা মিললেও সরকারের হিসেবে, দেশে মিনিকেট ধানের কোনো আবাদ নেই। মোটা চাল মেশিনে চিকন করে মিনিকেট নামে বিক্রি করছেন মিল মালিকেরা। তবে চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে মিনিকেট জাতের ধানের আবাদ হয়।
চালের উৎস ও ধানের জাত নির্ণয়ের জন্য ২১টি জেলায় সমীক্ষা চালানোর ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
এই তালিকায় আছে যশোর, ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, বগুড়া, নওগাঁ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ, কুড়ি়গ্রাম, গাইবান্ধা, রংপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ, দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, জামালপুর, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা, নোয়াখালী, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা।
এসব জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের চাল কোন কোন জাতের ধান থেকে তৈরি করা হচ্ছে- তা চিহ্নিত করা হবে। মাসখানেক আগে নেয়া এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করার দায়িত্ব পেয়েছেন খাদ্য মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা ও পরিধারণ ইউনিটের (এফপিএমইউ) ১৩ জন কর্মকর্তা।
কুষ্টিয়ার মিল মালিকদের দাবি, কিছু ক্ষেত্রে মোটা চাল পলিশ করে মিনিকেট হিসেবে বাজারজাত করার ঘটনা ঘটছে। তবে দেশে মিনিকেটের প্রচুর আবাদও হচ্ছে। এই ধান থেকে পাওয়া চাল বাজারজাত করছেন মিল মালিকেরা।
ফোর স্টার রাইস মিলের মালিক মো. মফিজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৯২ সালে প্রথম ভারত থেকে মিনিকেট জাতের ধান বাংলাদেশে আসে। সরকারি খাতা-কলমে হিসাব না থাকলেও এখন দেশে মিনিকেটের বিপুল আবাদ হচ্ছে।’