মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে যেতে রাজি করতে কম কাঠখড় পোহাতে হয়নি। তবে এই যাত্রায় প্রথম দলে অংশ নেয়া এক শরণার্থী বলেছেন, কক্সবাজারে ক্যাম্পের যে জীবন, সেখানে থাকা যায় না। এই পরিবেশ থেকে মুক্তির আশায় তিনি রাজি হয়েছেন নোয়াখালীর দ্বীপ ভাসানচরে যেতে।
২০১৭ সালের আগস্টে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশ আসার পর থেকে কক্সবাজারের বালুখালী ক্যাম্পে ছিলেন আয়শা বেগমের পরিবার। সেখানে বিনামূল্যে খাবার, চিকিৎসাসহ নানা আয়োজন ছিল। তবে ক্যাম্পের ঘিঞ্জি পরিবেশ, আয়ের সুনির্দিষ্ট উৎস না থাকাসহ নানা কারণে বিরক্ত ছিলেন এই নারী। তাই ভাসানচর যাওয়ার প্রস্তাব আসার পর লুফে নেন।
ভাসানচরের পরিবেশ আর কক্সবাজারের ক্যাম্পের পরিবেশের মধ্যে ফারাক বিস্তর। কক্সবাজার ক্যাম্পে থাকতে হয় কাচা ঘরে গাদাগাদি করে। বাইরের পরিবেশও ভালো না। লাখ লাখ মানুষ এক জায়গায় থাকলে সমস্যার অন্ত নেই। ছেলেপুলে একটু স্বস্তিতে খেলাধুলা করবে, সে উপায়ও নেই।
অন্যদিকে ভাসানচরে ব্লকের তৈরি বাসভবনগুলো কেবল দৃষ্টিনন্দনই নয়, সেখানে পয়নিঃষ্কাষণ থেকে শুরু করে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা বেশি। সবুজ প্রকৃতিতে স্বস্তিতে নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পাবে সবাই।
বুধবার দুপুরে কক্সবাজার ক্যাম্প থেকে ২০টি বাসে করে ৯২০ জন রোহিঙ্গাকে নিয়ে শুরু হয় যাত্রা। সন্ধ্যায় তারা পৌঁছে চট্টগ্রামের ট্রানজিট পয়েন্টে, যেখান থেকে জাহাজে করে তাদেরকে পাঠানো হবে ভাসানচরে।
বাস চট্টগ্রামে ঢোকার সময় নিউজবাংলার সঙ্গে কথা হয় আয়শার। বাসের জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে ক্ষণিকের জন্যই প্রতিক্রিয়া জানাতে পারেন তিনি।
মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের বুচিদং এলাকায় থাকতেন এই নারী। তিন সন্তান, স্বামীসহ আট সদস্যের পরিবার নিয়ে কোনো রকমে সীমান্ত অতিক্রম করে আসেন কক্সবাজার।
কেনো ভাসানচর যাচ্ছেন জানতে চাইলে আয়শা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভাসানচর গেইলি টিয়া হামাইত পাইজ্জুম। এতাল্লাই এন্ডে যাইর। ক্যাম্পত বেশি সুযোগ নাকি এন্ডে (ভাসানচরে গেলে নাকি আয় রোজগার করা যাবে। সেখানে নাকি বালুখালী ক্যাম্প থেকেও বেশি সুবিধা পাব। এজন্য ভাসানচর যাচ্ছি)।
কক্সবাজার ক্যাম্পে কেন ভালো লাগছি না?
আয়শা বেগম বলেন, ‘ক্যাম্পত মাইনষের টিয়া দিয়েরে চলন পরে। এল্লে আর হদিন চল্লুম। এহতল্লাই ভাসানচর যাইরগয় (ক্যাম্পে মানুষের টাকা দিয়ে চলতে হয়। এভাবে আর কত দিন চলব? তাই ভাসানচর চলে যাচ্ছি)।’
ভাসানচরের প্রকল্পটি শুরু হয় ২০১৮ সালে। দুই হাজার ৩১২ কোটি টাকায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে দেড় হাজার একতলা ভবন তৈরি করা হয়েছে। আরও আছে ১২০টি বহুতল ভবন, যা সাইক্লোন আশ্রয় কেন্দ্র ও অন্যান্য সময় অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হবে।
ভাসানচরে স্কুল, সেখানে স্কুল, কমিউনিটি সেন্টার, হাসপাতাল করা হয়েছে।
বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য আছে সোলার পাওয়ার। জেনারেটরের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। রান্নার জন্য সিলিন্ডার গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থাও থাকবে।
সেখানে রোহিঙ্গাদের আয়বর্ধকমূলক নানা প্রকল্পও নেয়া হয়েছে। খামারের কাজ, হাতের কাজ ছাড়াও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা থাকবে। ফলে আয় করতে পারবে রোহিঙ্গারা।
২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে সাড়ে সাত লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এর আগে থেকে ছিল আরও প্রায় চার লাখ। বর্তমানে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা রয়েছে ৩৪টি ক্যাম্পে।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে চুক্তি হলেও মিয়ানমারের অনাগ্রহের কারণে তা বাস্তবায়িত হয়নি। দুই বার প্রত্যাবাসনের খুব কাছাকাছি গিয়েও এক জন রোহিঙ্গাকেও ফেরত পাঠানো যায়নি মিয়ানমারের কারণে।
কক্সবাজার ক্যাম্পে ঘিঞ্জি পরিবেশ, ভূমিধসের আশঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতাসহ নানা কারণে সেখানে ভিড় কমাতে উদ্যোগ নেয় সরকার। যদিও বেশ কিছু এনজিও ও বিদেশি সংস্থার কারণে রোহিঙ্গাদেরকে স্থানান্তরে রাজি করানো যাচ্ছিল না। তবে সেপ্টেম্বরের শুরুতে একজন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরের সুযোগ-সুবিধা দেখিয়ে আনার পর একটি অংশ সেখানে যেতে রাজি হয়।