যেসব ফল এতকাল বিদেশি হিসেবে আমরা জেনে এসেছি, তার বেশিরভাগই এখন দেশে চাষ হচ্ছে। কিছু বিদেশি ফলের উৎপাদন এত বেড়ে গেছে যে তা ফুটপাতেও বিক্রি হচ্ছে। দেশে উৎপাদনের কারণে এগুলোর দামও অনেক কম।
কিছু ফল এ দেশের আবহাওয়া ও মাটিতে অভিযোজন করে নেওয়া হয়েছে। আবার কিছু ফলের বৈশিষ্ট্য পরিবর্তন করে দেশি জাত তৈরি করা হয়েছে।
যেসব বিদেশি ফল এ দেশে সফলভাবে অভিযোজিত হয়েছে, সেগুলো হলো ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি, রাম্বুটান, অ্যাভোকেডো, কাজুবাদাম, আঙুর, ম্যাঙ্গোস্টিন, নাশপতি, পার্সিমন, প্যাসন ফ্রুট, রুটিফল, লংগান, শানতোল, আলুবোখারা, টক আতা, জাবাটিকাবা, ক্যানটালোপ, রকমেলন, পাইনবেরি, চেরি, মাল্টা, থাই সফেদা, খাটো হাইব্রিড জাতের নারিকেল ইত্যাদি।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানান, বিদেশি ফলের চাষ পদ্ধতি নতুন। এগুলোর উৎপাদন প্রযুক্তি বা চাষ পদ্ধতি এ দেশের অনেক কৃষক জানে না। আর এই ফলগুলোর উৎপাদন বাড়াতে আমাদের প্রশিক্ষিত কৃষক দরকার হবে।
বিদেশি ফল কীভাবে এলো দেশে
এমন কিছু বিদেশি ফল আছে যেগুলোর চাষ অনেকে এ দেশে শুরু করেছেন নিতান্ত শখের বশে। কৌতূহলবশত অনেকেই বসতবাড়ির ছাদে, বারান্দা আঙিনায়, রাস্তায় পাশে, খেলার মাঠে, পুকুরপাড়, খোলা জায়গায় এসব ফলের চাষ শুরু করেন। অনেকের বাড়িতে আম, জাম, পেয়ারা, কলা, পেঁপে, কাঁঠালের পাশাপাশি সুবিধামতো স্থানে ড্রাগন ফ্রুট, স্ট্রবেরি, নাশপতি, আঙ্গুর, চেরি-মাল্টাও দেখা যেতে থাকে।
কিন্তু এগুলোর অনেকগুলোই এখন আর শৌখিন পর্যায়ে নেই। অনেকেই এই আবাদ থেকে বাণিজ্যিক লাভ খুঁজে পাচ্ছেন। ফলে চাষ বাড়ছে।
কৃষিবিদেরা বলছেন, সাধারণত কেউ দেশের বাইরে থেকে আসার সময় অনেক ফলের বীজ সঙ্গে করে নিয়ে আসেন। সেটার পেছনে কোনো বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য থাকে না। প্রথমে ঘরের বারান্দায় বা ছাদে লাগানো হলেও পরে আস্তে আস্তে ভালো কিছু হলে সকলের কৌতূহল বাড়ে এবং চাষের আগ্রহ তৈরি হয়।
শস্য উৎপাদন বিশেষজ্ঞ ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার নিউজবাংলাকে বলেন, এখন বৈজ্ঞানিকভাবে অনেক বিদেশি ফলের নতুন প্রজাতি তৈরি করা হচ্ছে। এখন আগের চেয়ে বেশি গবেষণা করা হচ্ছে। এখন ফলের দোকানগুলোতে আপেল আর খেজুর ছাড়া অন্যান্য ফল আমদানি করতে হচ্ছে না। দেশি কমলা এখন অনেক সহজলভ্য।
তিনি বলেন, ‘আগে দেশি কমলা অনেক টক হতো। কিন্তু এখন আর সেটা হচ্ছে না। কমলা মাটির ওপর নির্ভর করে। সেই সঙ্গে বৃষ্টিরও যোগ আছে।
‘মাটি ক্ষারীয় হলে ফল একটু টক হয় আর এসিডিক হলে ফল একটু মিষ্টি হবে। বৃষ্টি বেশি হলে বা ভেজা মাটিতে হলে সেটা টক হবে।’
একসময় বিদেশি ফল চাষের উপযুক্ত প্রযুক্তি ছিল ছিল না। ছিল না প্রযুক্তি উদ্ভাবনের গবেষণা। এখন দুটোই আছে। এখন এক একর জমিতে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা খরচ করলেই ২ লাখ টাকার ড্রাগনের ফলন পাওয়া যায়।
ড. মো. দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘বিদেশি ফলের প্রভাবে আমাদের দেশি ফল হারিয়ে যাবে এমন আশঙ্কা নেই। দেশি ফলের চাহিদা ও উৎপাদনও বাড়ছে। আবার বিদেশি অনেক ফলের জাত এনে সেটার সাথে দেশি ফলের সংকর ঘটিয়ে উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমন থাই পেয়ারা এবং পেঁপে।’
বিদেশি ফলের দেশি জাত
ড্রাগন ফল বা পিতায়া একধরনের ক্যাকটাস প্রজাতির ফল। চীনের লোকেরা এটিকে বলে আগুনে ড্রাগন, ভিয়েতনামে বলে মিষ্টি ড্রাগন, ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়াতে এটির নাম ড্রাগন ফল।
বর্তমানে এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ফল হিসেবে পরিচিত। কেননা এটি এখন তাইওয়ান, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, শ্রীলঙ্কা, মালয়েশিয়াতে ব্যাপক চাষ হয়।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (বারি) ড্রাগন ফল-১ নামে একটি উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছে। এই ফলের শাঁস গোলাপি রঙের। এতে প্রচুর পরিমাণে বিটা ক্যারোটিন ও ভিটামিন-সি রয়েছে। মে থেকে নভেম্বর সাত মাস জুড়ে ফলটি উৎপাদন সম্ভব।
দেশে ড্রাগন ফলের চাহিদার ৩০ শতাংশই পূরণ হচ্ছে দেশীয় উৎপাদন দিয়ে। এক সময় গুটিকয়েক ফলের বাজারে অভিজাত শ্রেণির জন্য এ ফল আমদানি হলেও এখন পাওয়া যায় ছোট-বড় সব বাজারেই।
অত্যন্ত রসালো রাম্বুটানের উৎপত্তি থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও মিয়ানমারে। এটি এক ধরনের গ্রীষ্মমণ্ডলীয় উদ্ভিদ। লিচু, লঙ্গান ইত্যাদি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় ফলের সাথে এর সাদৃশ্য রয়েছে। এর আকার মাঝারি ধরনের এবং বর্ণ লাল। এটি মিষ্টি স্বাদযুক্ত একটি ফল।
বারি অবমুক্ত করেছে রাম্বুটান-১ নামে একটি জাত। নরসিংদীতে অনেক দিন ধরে রাম্বুটানের চাষ হচ্ছে।
পার্সিমন ফলের উৎপত্তি পূর্ব এশিয়ায়। এ ফলটি পাঁচ বছর আগে দেশে এনে উপযোগী কৃষক পর্যায়ে ও হর্টিকালচার সেন্টারে বাগান সৃষ্টি করা হয়। এসব গাছে ফল ধরা শুরু হয়েছে। ১০ ধরনের ভিন্ন জাতের পার্সিমন হচ্ছে এখন এ দেশে।
ম্যাংগোস্টিন গাব প্রজাতির ফল। অত্যন্ত মিষ্টি ও সুস্বাদু। বিদেশি এ ফলের চারা কয়েকজন চাষির বাগানে এবং কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার সেন্টারে চাষ করে ভালো ফলন পাওয়া যাচ্ছে।
পাঁচ-সাত বছর ধরে মাল্টার চাষ দেশে জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। বারি যে মাল্টার জাত ছেড়েছে, সেটির গায়ের রঙ সবুজ। এ জন্য কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর অস্ট্রেলিয়া থেকে উন্নত জাত এনে চাষের উদ্যোগ নিয়েছে। বারি-২ ও বারি-৪ জাতসহ অস্ট্রেলিয়া ও পাকিস্তানের বিভিন্ন জাতের মাল্টার চাষ হচ্ছে গারো পাহাড়ে। বিদেশি মাল্টা রঙিন হলেও গারো পাহাড়ের মাল্টা সবুজ। কিন্তু এ মাল্টার স্বাদ ও গন্ধ অতুলনীয় ।
চাষিরা জানান, রাসায়নিক ব্যবহার করলেই এর রং বিদেশি মাল্টার মতো হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা সেটা করছেন না। তবে পাকা মাল্টার রং প্রাকৃতিকভাবেই কিছুটা হালকা কাঁচা হলুদের রং আসে। শেরপুরের খোলা বাজারে প্রতি কেজি মাল্টা ১৫০ থেকে ২০০ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে।
দেশি সফেদার জাতগুলো তেমন উন্নতমানের নয়। বর্তমানে থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনাম থেকে কিছু উন্নত জাতের সফেদা এনে চাষ শুরু হয়েছে। এই ফলে বীজ কম, খাওয়ার উপযোগী অংশ বেশি এবং রোপনের পরের বছর থেকেই ফল দেওয়া শুরু হয়।
খাটো ও হাইব্রিড জাতের নারিকেল বাংলাদেশের প্রচলিত নারিকেল গাছের জাতগুলো লম্বা জাতের, ফলনও তুলনামূলক কম। খাটো ও হাইব্রিড জাতের নারিকেল মুলত ভিয়েতনাম ও ভারত থেকে চাষ করা হচ্ছে।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সরকারিভাবে আরব দেশ থেকে উন্নত জাতের আরবি খেজুরের কলম আমদানি করে বিভিন্ন জেলার হর্টিকালচার সেন্টারগুলোতে দিয়েছে। এছাড়া চাষী পর্যায়ে বাগান সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।
কাজী পেয়ারার জায়গায় এখন ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে থাই পেয়ারা। ২০০০ সালের পর থাই পেয়ারার চাষ শুরু হয় দেশে। বাজার এখন এই পেয়ারার একচ্ছত্র দখলে। দক্ষিণাঞ্চলের পিরোজপুর জেলার স্বরূপকাঠি, চট্টগ্রাম জেলার কাঞ্চন নগর, ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার মুকুন্দপুরসহ কিছু এলাকা পেয়ারা চাষের জন্য সুপরিচিত।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে, বাংলাদেশে বছরে ১২ শতাংশ হারে ফলের উৎপাদন বাড়ছে। আর বছরে ১০-১১ শতাংশ হারে বাড়ছে ফল চাষের জমি। ফল চাষের জমি বাড়ার দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বের শীর্ষস্থানে উঠে এসেছে।
গুরুত্বপূর্ণ চারটি ফলের মোট উৎপাদনে বাংলাদেশ শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় উঠে এসেছে। দেশী ফল কাঁঠাল উৎপাদনে বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম, পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম ও পেঁপেতে চতুর্দশতম স্থানে আছে বাংলাদেশ। আর মৌসুমি ফল উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে দশম।
বিদেশি ফল রফতানির ভাবনা
চুয়াডাঙ্গা উপজেলা কৃষি পরিচালক তালহা জুবায়ের মাসরুর নিউজবাংলাকে বলেন, বিদেশি ফলগুলোর চাষ বাণিজ্যিকভাবে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সারা বিশ্বে এই ফলগুলোর আলাদা কদর আছে। বিশেষ করে ড্রাগন, র্যাম্বুটান বা পার্সিমনের চাহিদা অনেক বেশি।
তালহা জুবায়ের বলেন, ‘আমরা এখন খুব সফলভাবে এইসব ফল চাষ করে যাচ্ছি। বিশেষ করে ড্রাগন ফলটা। এর যেসব ট্রিটমেন্ট আছে, এখন সেইগুলোকে আরো বেশি গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে।’
জনপ্রিয় এ কৃষিবিদ আধুনিক কৃষির সঙ্গে তরুণদের সম্পৃক্ত করতে কৃষি বায়োস্কোপ নামে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম গড়ে তুলেছেন।
তালহা জুবায়ের বিদেশি ফলের বাণিজ্যিক গুরুত্বের কথা তুলে ধরে বলেন, ‘এখন আমদেরকে রপ্তানির কথা ভাবতে হবে। বড় ইন্ডাস্ট্রিকে এখানে যোগ দিতে হবে। থাইল্যান্ড, জাপান বা ভিয়েতনাম কিন্তু ড্রাগন ফল বা অন্য ফলগুলোকে লাভজনক পর্যায়ে নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ফলের চারা বা বীজগুলোর দিকে আরও নজর দিতে হবে। যারা এই বিষয়ে গবেষণা করেন, তাদের উচিত আরও বেশি মনযোগ দেয়া।