পর্যটক আনাগোনায় স্বস্তি ফিরছে পর্যটন নগরী কক্সবাজারে। তবে পর্যটকদের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতা কম। আর এ কারণে শীতে পর্যটন মৌসুমে করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি ও আবারও লকডাউন দেয়া হয় কিনা- তা নিয়ে শঙ্কায় পর্যটন ব্যবসায়ীরা।
হোটেল ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় পর্যটকদের আনাগোনা অন্তত ৭০ ভাগ কম। করোনাভীতির কারণেই এমন পরিস্থিতি।
কক্সবাজারের একটি আবাসিক হোটেল ‘রিসোর্ট আইল্যান্ডিয়া’র ব্যবস্থাপক ইব্রাহিম রায়হান নিউজবাংলাকে জানান, পর্যটক আকর্ষণে হোটেল ভাড়ায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ছাড় দিয়েও অতিথি পাচ্ছেন না তারা।
তিনি বলেন, ‘এ বছর এখন পর্যন্ত ব্যাচেলর পর্যটকের সংখ্যাই বেশি। প্রতি বছর এ মৌসুমে প্রচুর ফ্যামিলি ট্যুরিস্টের আগমন হয়। এ বছর এ ধরনের পর্যটক নেই বললেই চলে।’
কক্সবাজারের বেশিরভাগ হোটেলের প্রবেশপথে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা সরঞ্জাম দেখা গেলেও অনেক ক্ষেত্রে সেগুলোর প্রয়োগে রয়েছে ঢিলেঢালা ভাব। পর্যটকদের হাত জীবাণুমুক্ত করা কিংবা হাত ধোয়ার কড়াকড়িও চোখে পড়েনি।
‘হোটেল বিচ ওয়ে’র রিসেপশন এক্সিকিউটিভ সাঈদী হাসান জানান, পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে বলা হলেও অনেক সময় তারা তা মানছেন না।’
হোটেল সুরক্ষিত রাখতে কী করা হচ্ছে জানতে চাইলে তিনি জানান, হোটেলে প্রবেশের সময় সবাইকে বাধ্যতামূলক হ্যান্ড স্যানিটাইজ করাচ্ছে হোটেলগুলো। কোনো কক্ষের অতিথি চলে গেলে সেই কক্ষে অন্তত এক দিন নতুন কোনো অতিথিকে রাখা হচ্ছে না।
পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে দেখা যাচ্ছে না সমুদ্র সৈকতেও। নিরাপদ দূরত্ব রক্ষা করা কিংবা মাস্ক ব্যবহার করার প্রবণতা নেই বললেই চলে।
চট্টগ্রাম থেকে বেড়াতে আসা শিক্ষার্থী মোহসিন রানাকে দেখা গেল মাস্ক ছাড়া বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতে। কেন স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না জানতে চাইলে পকেট থেকে একটি মাস্ক বের করে জানালেন, ছবি তুলতে অসুবিধা হওয়ায় মাস্ক পকেটে রেখেছেন।
মোহসিন রানার মতো আরও অনেক পর্যটকের দেখা মিলল যারা এই সৈকতে মাস্ক না পরতে নানা অজুহাত দিচ্ছেন।
ঘোড়ার পিঠে আবার জিন
করোনা সংক্রমণের সময় দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার মাস বন্ধ ছিল কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকতে পর্যটন। আর এতে জীবিকা নিয়ে সবচেয়ে বেশি বিপদে ছিলেন সৈকতকেন্দ্রিক জীবিকা নির্বাহকারীরা। বেঁচে থাকার তাগিদে সাময়িকভাবে অন্য পেশায় যেতে হয়েছে অনেককেই। তারা ফিরতে শুরু করেছেন।
এদের একজন মো. তৌহিদুল ইসলাম। সমু্দ্র দেখতে আসা পর্যটকদের ঘোড়ায় চাপিয়ে সৈকত দেখান তিনি। করোনার সময় কখনও রিকশা চালিয়ে, কখনও বা রাজমিস্ত্রির কাজ করে সংসার চালিয়েছেন বলে জানান।
‘সাড়ে চার মাস অনেক কষ্টে কেটেছে। কখনও খেয়ে কখনও বা না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে। এখন কিছু পর্যটক আসছেন, তাতে অন্তত খেয়ে পরে বাঁচা যাচ্ছে’ বলছিলেন তিনি।
তৌহিদুলের মতো অবস্থা ছিল আরও অন্তত ৩২ ঘোড়ার মালিকের। পরিবার ও ঘোড়ার খাবার সংগ্রহ করতে হিমশিম খেতে হয়েছে তাদের।
সৈকতে ছাতাসহ বসার আসন ভাড়া দিয়ে স্বাভাবিক সময়ে দিনে সাত থেকে আট হাজার টাকা আয় ছিল আবদুস সালামের। করোনার মধ্যে ভাটা পড়ে এতে।
তিনি বলেন, ‘এখনও সৈকত জমেনি। সৈকতই আমাদের আয়ের একমাত্র জায়গা, এটি বন্ধ থাকলে আমাদের আয়ের সব পথ বন্ধ হয়ে যায়।’
পর্যটকরা সৈকতমুখী হওয়ায় আশার আলো দেখছেন বিচ ফটোগ্রাফাররাও। তাদের একজন সোহেল রানা জানান, অন্তত ৫৯৭ জন বিচ ফটোগ্রাফারের জীবিকা সৈকতকেন্দ্রিক।
‘পর্যটকরা ফিরলেও তাদের অনেকে স্বাস্থ্যবিধি মানছেন না। সংক্রমণ যদি বেড়ে যায় আর এ কারণে যদি আবারও লকডাউন দেয়া হয়, তাহলে আবারও অনিশ্চয়তায় পড়তে হবে আমাদের’ – বলছিলেন সোহেল রানা।
নজরদারি কতটুকু
সমুদ্র সৈকতে যেন পর্যটকরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন এ জন্য নজরদারি চলছে বলে দাবি করেছে প্রশাসন। কক্সবাজার টুরিস্ট পুলিশের সহকারী পুলিশ সুপার চৌধুরী মিজানুজ্জামান নিউজবাংলাকে জানান, এ জন্য সৈকতে প্রায়ই একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘পর্যটকদের মাস্কসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে বলা হচ্ছে। তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন এ জন্য নিয়মিত সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি পর্যটকদের বসার জায়গাগুলো নিয়মিত স্যাভলন দিয়ে পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।’
পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি নিয়ন্ত্রণে নিজের অসহায়ত্বের কথা তুলে ধরেন বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জাবেদ আহমেদ। তিনি নিউজবাংলাকে জানান, ‘নিজস্ব লোকবল না থাকায় স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিত হচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করতে স্থানীয় প্রশাসনের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।’
পর্যটকদের স্বাস্থ্যবিধি সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা স্থানীয় জেলা প্রশাসনকে দেয়ার কথাও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘হোটেল-মোটেলগুলোর দায়িত্ব, পর্যটকদের দায়িত্ব সংক্রান্ত সচেতনতা ক্যাম্পেইন নিয়মিত চালানো হচ্ছে। তবে সর্বোপরি নিজের নিরাপত্তা প্রথমে নিজেকেই নিশ্চিত করতে হবে। পর্যটকদের কাছে অনুরোধ থাকবে তারা যেন স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলেন।’