বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

এমসি কলেজে ধর্ষণ: অপরাধীরা ‘চিহ্নিত’, আড়ালে প্রশ্রয়দাতা

  •    
  • ১ ডিসেম্বর, ২০২০ ১৭:১৪

ধারাবাহিক খুনোখুনি, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ এবং সবশেষ ছাত্রাবাসের ভেতরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এই এলাকায়। আর সবটিতেই অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে।

সিলেটের মুরারীচাঁদ (এমসি) কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় অপরাধীদের ‘অনেকটাই চিহ্নিত’ করা গেছে বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা। ডিএনএ রিপোর্টেও ধর্ষণে চার আসামির জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে এখনও আড়ালেই থেকে গেছেন তাদের প্রশ্রয়দাতারা।

এমসি কলেজের অবস্থান নগরের টিলাগড় এলাকায়। এই এলাকাকেন্দ্রিক ছাত্রলীগের ‘অপকর্ম’ চলছে দীর্ঘদিন ধরে। একের পর এক বিতর্কিত ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সমালোচনার জন্ম দিয়েছে ‘টিলাগড় ছাত্রলীগ’। ধারাবাহিক খুনোখুনি, এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে অগ্নিসংযোগ এবং সবশেষ ছাত্রাবাসের ভেতরে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এই এলাকায়। আর সবটিতেই অভিযোগ উঠেছে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। এসব কর্মকাণ্ডের কারণে নগরবাসীর কাছে  টিলাগড় হয়ে উঠেছে আতঙ্কের এক নাম।

সবশেষ গত ২৫ সেপ্টেম্বর রাতে সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হন এক গৃহবধূ (২১)। ছাত্রাবাসের আঙিনায় স্বামীকে আটকে রেখে প্রাইভেট কারের ভেতর তাকে ধর্ষণ করা হয়। ওই রাতেই গৃহবধূর স্বামী মহানগরের শাহপরান থানায় মামলা করেন।

মামলার পর সিলেট বিভাগের বিভিন্ন স্থান থেকে এজাহারভুক্ত আসামি সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান ওরফে রনি, অর্জুন লস্কর, রবিউল ইসলাম, মাহফুজুর রহমান ওরফে মাসুম এবং সন্দেহভাজন আসামি মিসবাউর রহমান ওরফে রাজন ও আইনুদ্দিনকে গ্রেফতার করে পুলিশ।

গ্রেফতার সবাই আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তারা সবাই এমসি কলেজ ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে পরিচিত।

সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে রেখে এক নারীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ মামলার আট আসামি। ফাইল ছবি

গত ৩০ নভেম্বর এই ঘটনার ডিএনএ প্রতিবেদন আদালতের মাধ্যমে তদন্ত কর্মকর্তার কাছে পৌঁছায়। এতে ধর্ষণের সঙ্গে সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম ওরফে তারেক, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি ও অর্জুন লস্করের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শাহপরান থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত, আসামিদের জবানবন্দি ও ডিএনএ প্রতিবেদন সবকিছু মিলিয়ে ছাত্রাবাসের ধর্ষকদের অনেকটাই চিহ্নিত করা গেছে। শিগগিরই এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে জমা দেব।’

এমসি কলেজে ছাত্রবাসের ধর্ষণের পর এই এলাকার ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের প্রশয়দাতাদের খুঁজে বের করার দাবি ওঠে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেবল ছাত্রবাসে ধর্ষণই নয়, এর আগে ছাত্রাবাস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। মারামারি-চাঁদাবাজি তো প্রতিদিনকার ঘটনা। কাদের প্রশ্রয়ে ছাত্রলীগ পরিচয়ের তরুণরা এসব করে চলছে? অপরাধ করার পরও তারা পার পেয়ে যায় কাদের মদদে- সেই প্রশ্রয়দাতাদের খুঁজে বের করতে হবে। তাদের আইনি ও দলীয় শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে এলাকায় একের পর অপরাধ ঘটেই চলবে।’

তবে তদন্তে প্রশ্রয়দাতা হিসেবে কাউকে পাওয়া যায়নি বলে জানিয়েছে তদন্ত সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র। যদিও তদন্ত কর্মকর্তা বলছেন, তদন্ত এখনও শেষ হয়নি। এ বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদনে বিস্তারিত উল্লেখ করা হবে বলে জানিয়েছেন তিনি।

এমসি কলেজের একাধিক শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, সংঘবদ্ধ ধর্ষণে অভিযুক্তরা দীর্ঘদিন ধরে কলেজসহ আশপাশের এলাকায় বিভিন্ন অপকর্ম চালিয়ে আসছে। কলেজের বেড়াতে আসা নারীদের হয়রানি, শিক্ষার্থীদের অপদস্ত, চাঁদাবাজি, জায়গা দখলসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত তারা। সরকার দলীয় নেতাদের প্রশ্রয় থাকায় কেউ তাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস পায়নি। কলেজ প্রশাসনও চলত তাদের কথায়।

অভিযোগ রয়েছে, টিলাগড় এলাকার দুই আওয়ামী লীগ নেতার প্রশ্রয়েই বেপরোয়া এখানকার ছাত্রলীগ। সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের গত কমিটির শিক্ষা বিষয়ক সম্পাদক ও স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর আজাদুর রহমান আজাদ এবং সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের গত কমিটিতে যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক রণজিত সরকার এই এলাকার ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। তাদের দুজনের দ্বন্দ্বের কারণে এই এলাকায় নিয়মিত সংঘাত লেগে থাকে।

সিলেট জেলা ও মহানগর আওয়ামী লীগের প্রস্তাবিত কমিটিতে রণজিত ও আজদের নাম সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছে।

অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা রণজিত সরকার

সিলেট নগরের টিলাগড় ও বালুচর এলাকায় এমসি কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজসহ আরও কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এছাড়া কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে এই এলাকায়। এসব প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার, দরপত্র কার্যক্রমসহ বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকাণ্ড নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে তৎপর স্থনীয় ছাত্রলীগ নেতারা। আজাদুর রহমান ও রণজিত সরকার তাদের মদদ দিয়ে থাকেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

আজাদ ও রণজিত এককালে বন্ধু ছিলেন। তবে এসব প্রতিষ্ঠানে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। এর পর থেকেই এলাকায় বেড়ে যায় সংঘাত ও খুনোখুনির ঘটনা। টিলাগড় এলাকার ছাত্রলীগ এখন দুটি বলয়ে বিভক্ত। তাদের মধ্যে একটি ‘আজাদ অনুসারী’ ও অপরটি ‘রণজিত অনুসারী’ হিসেবে পরিচিত। ছাত্রবাসে ধর্ষণের দায়ে অভিযুক্তরা সবাই ‘রণজিত অনুসারী’ বলে জানা গেছে। করোনার কারণে বন্ধ থাকার সময়েও রণজিত অনুসারীরা এমসি কলেজ ছাত্রাবাস দখল করে রেখেছিলেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

তবে আজাদুর রহমান আজাদ ও রণজিত সরকার দুই জনেই এমন অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে ঘায়েল করার জন্যই তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনা হচ্ছে।

রণজিত সরকার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি ছাত্ররাজনীতি ছেড়েছি অনেক আগে। এখন ছাত্রলীগের সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। কেবল টিলাগড় এলাকায় বাসা হওয়ার কারণে এই এলাকায় কোনো ঘটনা ঘটলেই আমার নাম চলে আসে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমাকে ঘায়েল করার জন্য এমন অপপ্রচার চালায়।’

আর আজাদুর রহমান আজাদ বলেন, ‘এই  এলাকার চার বারের নির্বাচিত কাউন্সিলর আমি। সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের প্রশ্রয় দিলে জনগণ আমাকে ভোট দিত না। আমার বিরুদ্ধে ছাত্রলীগের গ্রুপ তৈরি করা ও সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ অমূলক।’

অভিযুক্ত আওয়ামী লীগ নেতা আজাদুর রহমান আজাদ

ধর্ষণকাণ্ডের আগে ২০১২ সালে দেশজুড়ে আলোচনায় আসে এমসি কলেজ ছাত্রাবাস। ২০১২ সালের ৮ জুলাই ছাত্রলীগ-শিবির সংঘর্ষের জেরে সোয়াশ বছরের প্রাচীন এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে আগুন দেয়া হয়। এতে ছাত্রাবাসের ৪২টি কক্ষ পুড়ে যায়। সে ঘটনায় যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয় তারা সবাই আজাদ ও রণজিত অনুসারী ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা হিসেবে পরিচিত। তবে আলোচিত সেই ঘটনার বিচার আজ পর্যন্ত শেষ হয়নি।

এছাড়া মারামারি-খুনোখুনি এই এলাকার নিয়মিত ঘটনা। ২০১০ সালের ১২ জুলাই অভ্যন্তরীণ বিরোধের জের ধরে টিলাগড়ে খুন হন এমসি কলেজের গণিত বিভাগের ছাত্র উদয়েন্দু সিংহ পলাশ। ২০১৮ সালের ৭ জানুয়ারি টিলাগড় পয়েন্টে প্রতিপক্ষের নেতাকর্মীদের ছুরিকাঘাতে খুন হন সিলেট সরকারি কলেজ ছাত্রলীগ নেতা তানিম আহমদ খান। =২০১৮ সালের ১৬ অক্টোবর টিলাগড়ে ছাত্রলীগ কর্মী ওমর আহমদ মিয়াদকে (২২)  ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।

এর আগে ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর টিলাগড়ের পাশের শিবগঞ্জে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী জাকারিয়া মোহাম্মদ মাসুম। আর ২০২০ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি পূজার টাকার ভাগ-ভাটোয়ারা নিয়ে খুন হন ছাত্রলীগ কর্মী অভিষেক দে দ্বীপ।

এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের পর সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার নাগরিকদের নিয়ে গড়ে ওঠে ‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’ নামে একটি নাগরিক প্ল্যাটফর্ম। এই প্ল্যাটফর্ম থেকে ধর্ষকদের বিচারের দাবি জানানোর পাশপাশি টিলাগড়ের গডফাদারদের চিহ্নিত এবং এই এলাকাকে গডফাদারমুক্ত করার দাবিতেও বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়।

‘দুষ্কাল প্রতিরোধে আমরা’-এর সংগঠক আব্দুল করিম কিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কেবল ছাত্রলীগের দুয়েকজন অপরাধীকে শাস্তি দিলে এই এলাকার অপরাধ থামবে না। কারণ গডফাদাররা নতুন নতুন অপরাধী তৈরি করবে। তাদের লুটপাট-অবৈধ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে তরুণদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করবে। ফলে গডফাদারদের শাস্তি নিশ্চিত করাই জরুরি।’

দলের দুই নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রসঙ্গে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসির উদ্দিন খান বলেন, এসব অভিযোগ কেন্দ্রীয় নেতাদের জানানো হয়েছে। তারাও এসব তদন্ত করে দেখছেন। অভিযোগের প্রমাণ পেলে তাদের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় নেতারা সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেবেন।

এ বিভাগের আরো খবর