একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিশ্ব গণমাধ্যমে বহুল আলোচিত ঘটনা। দুর্গম সংবাদপ্রবাহের সেই সময়েও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর দ্রুত দেশের সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়েছিল। বিশ্ব গণমাধ্যম ও সাংবাদিকদের সুবাদে পৃথিবীর মানুষ পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার খবরের পাশাপাশি জানতে পেরেছিল মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের সমাচার।
১৯৭১ সালে নয় মাস বাংলাদেশে যুদ্ধের ভয়াবহতা আড়ালে রাখতে সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টাই করেছিল পাকিস্তান সরকার। এর অন্যতম ছিল সংবাদমাধ্যমকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে না দেয়া।
মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে শহিদ হন অনেক সাংবাদকর্মী। তার পরও অবরুদ্ধ সময়ে জীবন বাজি রেখে অনেক বিদেশি সাংবাদিক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির সংবাদ সংগ্রহ করেছিলেন, প্রকাশ করেছিলেন বিভিন্ন গণমাধ্যমে। সেসব প্রতিবেদন, আলোকচিত্র ও ভিডিও ফুটেজ কেবল বাংলাদেশের বিজয়কে ত্বরান্বিত করেনি, সময়ের পরিক্রমায় তা হয়ে উঠেছে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল।
মহান বিজয়ের মাসে এমন কয়েক জন বিদেশি ‘মুক্তিযোদ্ধা’ সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের ভূমিকা স্মরণ করছে নিউজবাংলা।
সাইমন ড্রিং
১৯৭১ সালে বিলাতি দৈনিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং ছিলেন কম্বোডিয়ার রাজধানী নমপেনে। মার্চ মাসের শুরুতে লন্ডনের সদর দফতর থেকে তাকে ফোন করে ঢাকায় যেতে বলা হয়।
সাইমন ড্রিং ৬ মার্চ ঢাকায় এসে পরের দিন ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ প্রত্যক্ষ করেন। মূলত এই ভাষণের মাধ্যমেই পাকিস্তানের রাজনীতি ও পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলন-সংগ্রাম সম্পর্কে তার সরাসরি অভিজ্ঞতার শুরু। এরপর তিনি সখ্য গড়ে তোলেন আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতাকর্মী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে।
সাইমন ড্রিং ঢাকায় এসেছিলেন সপ্তাহের জন্য। কিন্তু তিনি সেই সিদ্ধান্ত বদলে ফেলেন। পূর্ব পাকিস্তানের অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি নিয়ে একের পর এক রিপোর্ট পাঠাতে থাকেন টেলিগ্রাফ পত্রিকায়।
সাইমন ড্রিং উঠেছিলেন শাহবাগের তখনকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে। ২৫ মার্চ মধ্যরাতে পাকিস্তানি সামরিক বাহিনী হত্যাযজ্ঞ শুরু করার আগেই ঢাকায় অবস্থানরত সব বিদেশি সাংবাদিককে ওই হোটেলে অবরুদ্ধ করে ফেলে। পরদিন সকালেই তাদের বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে তুলে দেয়া হয় উড়োজাহাজে।
কিন্তু সাইমন ড্রিং প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে হোটেলেই লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের বিখ্যাত প্রতিবেদন।
ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ৩০ মার্চ সেটা ছাপা হয়।
ওই দিনই সাইমনকে লন্ডন চলে যেতে হয়। এরপর কলকাতায় আসেন নভেম্বরে; সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের খবর সংগ্রহ করে পাঠিয়ে দিতেন লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায়। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায়।
মাইকেল লরেন্ট
২৫ মার্চের গণহত্যার আরেক প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেসের (এপি) আলোকচিত্রী মাইকেল লরেন্ট।
এ সময় তিনি ও সাইমন ড্রিং কর্মচারীদের সহযোগিতায় হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের একটা রান্নাঘরে লুকিয়ে ছিলেন। ২৭ মার্চ সকালে দুই ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠলে তারা দুই জন একসঙ্গে বেরিয়ে পড়েন। দেখেন সড়ক, ছাত্রাবাস, বস্তি—সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞ, লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে।
১০–২০–৪০–৮০...আর গুনতে পারলেন না তারা। পরে পাকিস্তানি সেনাদের চোখ এড়িয়ে মাইকেল লরেন্ট তার ছবিগুলো পাঠান জার্মান দূতাবাসের মাধ্যমে।
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস
অ্যান্থনি মাসকারেনহাস ছিলেন করাচির মর্নিং নিউজের সাংবাদিক ও ব্রিটেনের সানডে টাইমস পত্রিকার পাকিস্তান সংবাদদাতা। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে পাকিস্তান সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আট জন সাংবাদিককে পূর্ব বাংলায় নিয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের ঢাকা, কুমিল্লা, যশোরসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরিয়ে দেখায়। বোঝাতে চেষ্টা করে এখানকার পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক। কেবল অল্পসংখ্যক দুষ্কৃতিকারী সীমান্তে কিছু সমস্যা তৈরি করছে।
কিন্তু আট সাংবাদিকের মধ্যে সাত জন পাকিস্তান সরকারের চাহিদা অনুসারে প্রতিবেদন করলেও তাতে বাদ সাধেন মাসকারেনহাস। করাচি ফিরে তিনি ১৮ মে লন্ডনে হাজির হন সানডে টাইমসের দফতরে। সেখানে পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি নিয়ে একটি প্রতিবেদন লেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন তিনি।
সেই প্রতিবেদনে মাসকারেনহাস লেখেন, ‘পূর্ব বাংলার শ্যামল প্রান্তরজুড়ে আমি আমার প্রথম চাহনিতেই জমাট রক্তপুঞ্জের দাগ দেখতে পেয়েছিলাম। এই সংঘবদ্ধ নিপীড়নের শিকার কেবল হিন্দুরাই নয়, হাজার হাজার বাঙালি মুসলমানও এ নির্মমতার শিকার।’
একাত্তরের ১৩ জুন সানডে টাইমস দুই পৃষ্ঠাজুড়ে মাসকারেনহাসের প্রতিবেদনটি ছাপে। শিরোনাম ছিল এক শব্দের, ‘জেনোসাইড’।
পরবর্তী সময়ে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভান্সকে বলেছিলেন, লেখাটি তাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল। এটি তাকে ইউরোপীয় রাজধানীগুলো আর মস্কোয় ব্যক্তিগতভাবে কূটনৈতিক পদক্ষেপ নিতে উৎসাহ দেয়, যাতে ভারত সশস্ত্র হস্তক্ষেপ করতে পারে।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের আগে মাসকারেনহাস পাকিস্তানে গিয়ে তার স্ত্রী-সন্তানদের বের করে আনেন।
মার্ক টালি
একাত্তরে মার্ক টালি বিবিসির দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সংবাদদাতা ছিলেন। যুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের আশার আলো। রেডিওতে কান পেতে সকাল-সন্ধ্যা তার কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায় থাকত পুরো দেশ। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠনে তার ভূমিকা ছিল অনন্য।
মার্ক টালি ২৫ মার্চের বর্বর হামলা প্রত্যক্ষ করেছিলেন। পরে তাকে ঢাকা ছেড়ে যেতে হয়। অবশ্য জুনের তৃতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা বিদেশি সাংবাদিকদের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নিলে বিবিসি তাকে আবার বাংলাদেশে পাঠায়।
মার্ক টালি তখন ঢাকায় না এলেও তিনি সীমান্তবর্তী বিভিন্ন শরণার্থী শিবির ও জেলাগুলো ঘুরে বাঙালির দুর্দশা ও যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির খবর পাঠাতে থাকেন দিল্লি থেকে। আবার লন্ডনে বসেও তিনি যুদ্ধের বিভিন্ন দিক নিয়ে বিশ্লেষণ হাজির করতেন।
সিডনি শনবার্গ
একাত্তরে মার্কিন সাংবাদিক সিডনি শনবার্গ ছিলেন নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশীয় সংবাদদাতা। মুক্তিযুদ্ধের শুরুর দিকে ২৫ ও ২৬ মার্চ ঢাকায় ছিলেন তিনি। গণহত্যার খবর প্রচার করায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাকে দেশ থেকে বহিষ্কার করে। এরপরও তিনি বারবার ফিরে এসেছেন সীমান্ত এলাকায়। কখনো ঢুকে গেছেন মুক্তাঞ্চলে। কথা বলেছেন মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকসহ বহু প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে।
২৮ মার্চ নিউইয়র্ক টাইমসে ‘In Dacca, Troops use Artillery to halt revolt’ শিরোনামে শনবার্গের যে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়, তাতে তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিরীহ বাঙালির ওপর পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বরতার বর্ণনা করেন। তিনি এই সামরিক অভিযানকে আখ্যায়িত করেন ‘পাইকারি হত্যাকাণ্ড’ হিসেবে।
১৬ ডিসেম্বর শনবার্গ মিত্রবাহিনীর ট্যাংকে সওয়ার হয়ে প্রবেশ করেন ঢাকায়। তিনি উপস্থিত ছিলেন পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানেও। ২৫ মার্চের গণহত্যা ও ১৬ ডিসেম্বরের বিজয়ের মুহূর্ত- দুটিরই প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। মাঝে নয় মাসজুড়ে নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত হয় তার অনেক প্রতিবেদন। এসব প্রতিবেদন হয়ে উঠেছে এক সাংবাদিকের কলমে লেখা মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ইতিহাস।
পরে সিডনি শনবার্গ খ্যাতি অর্জন করেন কম্বোডিয়ার গণহত্যার সংবাদভাষ্য প্রদান করে, যা তাকে এনে দেয় পুলিৎজার পুরস্কার।
ভারতীয় গণমাধ্যম
ভারতের গণমাধ্যমগুলো ২৭ মার্চ থেকেই পাকিস্তানিদের নৃশংসতা ও বাঙালির প্রতিরোধযুদ্ধের খবর প্রকাশ ও প্রচার করছিল। এ ক্ষেত্রে কলকাতা ও আগরতলার বাংলা পত্রিকাগুলো অগ্রণী ভূমিকা নেয়।
ডিসেম্বরে মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে গিয়ে সরেজমিন প্রতিবেদন করেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়।
অন্নদাশঙ্কর রায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়, আবু সয়ীদ আইয়ুব ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মতো লেখক-কবিরাও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কলম ধরেন। আর আকাশবাণীতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভরাট কণ্ঠে যুদ্ধের সংবাদ পর্যালোচনাও ছিল অত্যন্ত হৃদয়কাড়া।