ধর্ষণের এক মামলার বাদীকে বিয়ের পর আসামিকে জামিন দেয়ার সময় হাইকোর্ট বলেছে, কোনো শর্ত দিয়ে বৈবাহিক সম্পর্ক টিকিয়ে রাখা যায় না। এখন সমাজে মানুষের সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না।
জামিন শুনানিতে পত্রিকার কিছু প্রতিবেদন এবং নারীবাদী কয়েকটি সংগঠনের বক্তব্যের সমালোচনাও করেছে আদালত।
ধর্ষণ মামলার আসামি ফেনীর জহিরুল ইসলাম ওরফে জিয়া উদ্দিনকে সোমবার এক বছরের জামিন দেয় বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি মোস্তাফিজুর রহমানের হাইকোর্ট বেঞ্চ।
- আরও পড়ুন: কারাগারে বিয়ে: ধর্ষণের আসামির জামিন
মামলার বাদীকে বিয়ে করায় জিয়ার জামিনের আবেদনটি বিবেচনায় নিয়েছে আদালত।
ফেনীর কারা ফটকে ধর্ষণ মামলার আসামি জিয়ার সঙ্গে অভিযোগকারী তরুণীর বিয়ের ঘটনাটি ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। নারী অধিকার কর্মীদের অনেকে বিষয়টির সমালোচনাও করছেন।
হাইকোর্টে সোমবার জিয়ার জামিন শুনানির সময়ে এ বিষয়টি নিয়ে কথা বলেন বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম।
তিনি বলেন, “আমরা তো নানাভাবে সমালোচিত হচ্ছি। ব্যক্তিগতভাবে দুই-একটি পত্রিকার রিপোর্ট দেখে খুব অফেন্ডেড হয়েছি। যেখানে লেখা হয়েছে ‘ধর্ষকের সাথে ধর্ষিতার বিয়ে’। এভাবে তো রিপোর্ট হওয়া উচিত না। আবার নারীবাদী সংগঠনগুলো বলছে, এ ধরনের বিয়েতে ধর্ষকেরা উৎসাহিত হবে।''
‘যে যা-ই সমালোচনা করুক, আমরা এটাকে উৎসাহিত করব’- মন্তব্য করে বিচারক বলেন, ‘প্রযুক্তির কারণে এখন সমাজে মানুষের সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। দেখবেন আমাদের দেশে ডিভোর্সের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে বেশি হচ্ছে, বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাটা কম।’
শুনানিতে জামিন প্রার্থনা করে আসামিপক্ষের আইনজীবী ফারুক আলমগীর চৌধুরী বলেন, ‘যেখানে মামলায় মেয়েটা বলছে, আমি তাকে দীর্ঘ দিন ধরে ভালোবাসি, তার সঙ্গে আমার মনোমালিন্য হয়েছে। এখানে দেখতে হবে অন্যায় কিছু হয়েছে কিনা। মেয়েটা বলছে, আমার সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক, কিন্তু বিয়ে না করায় থানায় মামলা করা হয়েছে। এটা নিয়ে জজ কোর্টেও আপস করার চেষ্টা করেছে মেয়েটি। তারপর তারা হাইকোর্টে এসেছে। সবার উপস্থিতিতে বিয়ে হয়েছে, এখানে অন্যায়ের কী হয়েছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘এভাবে কথায় কথায় যদি ধর্ষণের মামলা হয়ে যায়, যেখানে ধর্ষণের কোনো ভিত্তি নাই্, কোনো মেডিকেল রিপোর্টও নাই। তারপরেও কেন জামিন হবে না!’
এ সময় আদালতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বিয়েটি টিকিয়ে রাখতে আদালতের কাছ থেকে নির্দেশনা চান।
আদালতের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘এমন আদেশ দেয়া হোক যাতে ভবিষ্যতে কোনো সমস্যা না হয়। বিয়ের কারণে এখন জামিন হয়ে গেল। পরে যাতে এই সংসার ভেঙে না যায় সেজন্য কোনো নির্দেশনা বা কঠোরতা দেয়া যায় কিনা ভেবে দেখবেন।’
এ পর্যায়ে বেঞ্চের জ্যেষ্ঠ বিচারক বলেন, ‘মিস্টার ডিএজি ঘর সংসার কি কোনো কঠোরতা দিয়ে টেকানো যাবে। ১৫/২০ বছর সংসার করার পরেও ঘর ভেঙ যাচ্ছে। শিক্ষিত লোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর দুই জনই কোর্টে এসেছেন। দেখা গেছে তাদেরও এতদিনের ঘর সংসার ভেঙে গেছে। আদেশ নিষেধ নিয়ে কি ঘর সংসার টিকানো যাবে!’
এ সময় একটি শর্ত দিয়ে জামিন দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী।
বিচারক এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, ‘আমরা যদি কোনো শর্ত দিয়ে দেই যে, মেয়ের সঙ্গে কোনো খারাপ আচরণ করলে জামিন বাতিল হবে; তাহলে দেখা যাবে মেয়ে যদি বলে আমাকে আগে ১০ বিঘা সম্পত্তি লিখে দিতে হবে…, সমাজে এমন ঘটনা কিন্তু ঘটছে। সব থেকে বড় কথা হলো দুজনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটাই আসল।
‘প্রযুক্তির কারণে, ফেসবুকের কারণে এখন সমাজে মানুষের সম্পর্ক গড়তেও সময় লাগে না, ভাঙতেও সময় লাগে না। দেখবেন আমাদের দেশে ডিভোর্সের সংখ্যা অনেকাংশে বেড়ে গেছে। শিক্ষিত লোকদের মধ্যে বেশি হচ্ছে। বরং সাধারণ মানুষের মধ্যে এই প্রবণতাটা কম।’
জামিনের অপব্যবহার হলে ওই নারীর সামনে অভিযোগ জানানোর সুযোগ থাকার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দেয় হাইকোর্ট।
আদালত বলেছে, ‘আমরা আশা করব সংসারটা ভালোভাবে চলুক। বিয়ে প্রতারণামূলক হলে একাধিক মামলাও হবে।’
আসামিপক্ষের আইনজীবীও এ সময় বলেন, ‘তারা আমার এলাকার বাসিন্দা, আমিও বিষয়টি খেয়াল রাখব।’
ফেনীর কারাগারে বন্দি জিয়া উদ্দিনের সঙ্গে গত ১৯ নভেম্বর বিয়ে হয় ওই নারীর। জিয়ার বাড়ি ফেনীর সোনাগাজীর ৮ নং চরদরবেশ ইউনিয়নের দক্ষিণ পশ্চিম চর দরবেশ গ্রামে।
একই ঘরে অবস্থান করা অবস্থায় গত ২৭ মে ভোরে গ্রামবাসী জিয়া ও অভিযোগকারী মেয়েটিকে আটক করে। স্থানীয়রা দুজনকে বিয়ে দিতে চাইলে জিয়া ও তার পরিবার এতে রাজি হয়নি। সেদিন মেয়েটি সোনাগাজী থানায় ধর্ষণ মামলা করেন। পুলিশ ওইদিনই জিয়াকে গ্রেপ্তার করে।
বিচারিক আদালতে ব্যর্থ হয়ে জিয়া পরে জামিনের জন্য হাইকোর্টে আবেদন করেন তিনি। এর শুনানি নিয়ে আদালত গত ১ নভেম্বর ‘উভয়পক্ষের সম্মতি থাকলে’ বিয়ের ব্যবস্থা করতে কারাকর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়।
দুজনের বিয়ের বিষয়টি সোমবার আদালতে উত্থাপনের পর এক বছরের জামিন পান জিয়া।