‘যানজটের নগরী’ ঢাকায় অল্প সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইকের চেয়ে দ্রুত বাহন আর নেই। তবে জনপ্রিয় এই সেবা আর আগের মতো অ্যাপনির্ভর নেই। অনেক চালক তার অ্যাপ বন্ধ করেই যাত্রী পরিবহন করেন। অনেক যাত্রীও ‘কিছুটা লাভের’ আশায় তাদের সঙ্গে ‘চুক্তিতে’ যান।
চালক ও যাত্রীদের এই অনিয়মের সুযোগে চাঁদাবাজিতে মেতেছেন অনেকে। রাজধানীর ব্যস্ত মোড়ে মোড়ে চাঁদার টাকা তোলার লোক ঠিক করা আছে ‘বড় ভাইদের’। টাকা না দিলে গাড়ি ছাড়তে দেয়া হয় না। প্রশ্ন করলে পড়তে হয় ‘ঝামেলায়’।
অভিযোগ আছে, চাঁদাবাজির এই সিন্ডিকেটে আছে ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরাও।
চালক ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, শুরুর দিকে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং নিয়ম মাফিকই ছিল। গত মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ শুরুর কয়েক মাস আগেই শুরু হয় ‘কন্টাক্টে’ চলাচল। লকডাউন শেষে আবার বাড়তে থাকে চুক্তিতে চলাচল।
এখন নিবন্ধিত বেশিরভাগ চালক ও যাত্রী চুক্তিতে চলাচল করছেন। এর প্রধান কারণ কোম্পানিকে ফাঁকি দিয়ে ‘দুই পয়সা’ বাড়তি আয় করা বা কম ব্যয় করা। অনেকে আবার সঠিকভাবে অ্যাপ ব্যবহার করতে পারেন না। অনেকের অ্যাপ ব্যবহার করার মতো মোবাইল ফোনও নেই।
বাইকচালক মো. সাদ্দাম নিউজবাংলাকে বলেন, যাত্রাবাড়ী, মোহাম্মদপুর, বসিলা, সাইনবোর্ড, মাতুয়াইল, সদরঘাট, স্টাফ কোয়ার্টার, শনির আখড়া, ফুলবাড়িয়াসহ রাজধানীর বেশ কিছু জায়গায় কিছু মানুষ প্রভাব খাটিয়ে চাঁদা তোলেন। যারা চাঁদা তুলছেন তারা বলছেন, এই টাকার ভাগ পুলিশসহ বিভিন্ন ‘জায়গায়’ দেয়া লাগে।
‘আপনারা কি এই চাঁদাবাজির প্রতিবাদ করেন না?’
জবাবে সাদ্দাম বলেন, ‘প্রতিবাদ করতে গেলে ১০-১৫ জন একসঙ্গে এসে ঝামেলা করে। হুমকি দেয়। এ কারণে ১০ টাকা দিয়ে ঝামেলা মুক্ত থাকি।’
কোনো কোনো স্ট্যান্ডে প্রায় এক বছর আগে থেকেই এই চাঁদাবাজি চলছে বলে অভিযোগ করেন বাইক রাইডার আবু জাফর।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমরা যারা গাড়ি চালাই, এই গাড়িকে কেন্দ্র করে অনেক স্ট্যান্ডে আমাদের থেকে চাঁদা নেয়া হয়। কোনো স্ট্যান্ডে ১০ টাকা, কোনো স্ট্যান্ডে ২০ টাকা নেয়া হয়। অন্যান্য জায়গায় ১০ টাকা দিলেও স্টাফ কোয়ার্টারে ২০ টাকা দিতে হয়।’
আবু জাফর আক্ষেপ করে বলেন, ‘এই বাইক চালিয়ে কোনোভাবে জীবন চালাই। আর তারা কোনো কাজ না করে এইভাবে চাঁদা তুলে খায়।’
তিনি বলেন, ‘স্থানীয় ছেলেরাও কিছু সমস্যা করে। আমরা দূর থেকে যারা যাই, আমাদের ট্রিপ না দিয়ে তারা জোর করে ট্রিপ নিয়ে চলে যায়।’
রোববার যাত্রাবাড়ী মোড়ে এ রকম বাইক চালকদের কাছ থেকে চাঁদা তুলছিলেন আজাদ নামের এক তরুণ। চাঁদা তোলার কারণ জানতে চাইলে প্রথমে তিনি কোনো জবাব দিতে চাননি।
এক পর্যায়ে বলেন, ‘আমি এখান থেকে টাকা তুলে আমার বড় ভাই মিরাজকে দেই। উঠানো টাকা থেকে ভাই আমায় টাকা দেন। এটা আমার কর্ম। মানুষ যে কাজ করে এইডাই তার কর্ম।’
এ সময় পাশ থেকে বিপ্লব নামে এক বাইক রাইডার বিরক্তির সুরে বলেন, ‘ভাই আমাগো কে জ্বালায় জানেন না? গাড়ি পার্কিং করলে তো মামলা দেয়। মামলা দেয় কারা? তারাই টাকা নেয়। বুঝেন নাই ব্যাপারডা? এই হানে বড় একটা সিন্ডিকেট আছে ভাই।’
মহাখালীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বসিলার অপূর্ব রায়। মাঝেমধ্যেই অ্যাপভিত্তিক মোটরবাইকে চলাফেরা করেন জানিয়ে রোববার নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘বেড়িবাঁধ মোড়ে বাস না পেয়ে বাইক নেয়ার কথা ভাবলাম। সঙ্গে স্মার্টফোন না থাকায় অ্যাপ থেকে কল করতে পারছি না। এর মধ্যেই রাস্তার মোড় ঘুরে একজন সামনে এসে জিজ্ঞেস করলো কোথায় যাবেন?
‘মহাখালীর কথা বলতেই ১২০ টাকায় ভাড়া ঠিক হলো। কিন্তু যখনই বাইকে উঠতে যাব, তখনই এক লোক দৌড়ে এসে বলনে, ভাই এই বাইকে উঠতে পারবেন না। এইখানে সিরিয়াল দেয়া আছে। বাইক নিতে হলে এখান থেকেই নিতে হবে বলে প্রথমে আসা লোককে তাড়িয়ে দিলেন তারা। তাদের নিয়ম নাকি এটাই।’
অপূর্ব রায় বলেন, ‘তাদের কথামতো যেই বাইকে উঠে বসলাম, আরেকজন দৌড়ে আসল; তার হাতে বাইকচালক ১০ টাকা দিলেন। জিজ্ঞাসা করলাম কিসের টাকা? বলে এখান থেকে যাত্রী নিলে প্রতি ট্রিপে ১০ টাকা দিতে হয়। এখানকার সিন্ডিকেটের নিয়ম এটাই। সিন্ডিকেট সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে বাইকচালক চুপ হয়ে যান।’
এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপকমিশনার মো. ওয়ালিদ হোসেন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যদি কেউ এভাবে টাকা নিয়ে থাকে তবে সেটা সম্পূর্ণ অবৈধ। এটা অবশ্যই শাস্তিযোগ্য অপরাধ; সে যেই হোক না কেন। এই টাকা কারা নিচ্ছে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নিব। আমরা বিষয়টা খোঁজ নিয়ে দেখব।’