শোয়ার ঘরের বিছানার ভারী ম্যাট্রেসের প্রায় পুরোটাই পোড়া। বিছানার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে জমাট বাঁধা রক্ত।
ধারাল অস্ত্রের আঘাতে পেছন থেকে ক্ষতবিক্ষত শরীর। সেই গায়ে আবার দাহ্য পদার্থ ঢেলে আগুন। আর গলায় প্যাঁচানো লুঙ্গি।
নিজ ঘরে নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন ঢাকার কাফরুলের ইমামনগরের তাজ ল্যান্ড প্রোপার্টিজের একটি বাড়িতে বসবাস করা সীমা বেগম।
রোববার বেলা ১১টার দিকে এই হত্যার ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ মরদেহ উদ্ধার করে দুপুরের পর।
সীমা বেগমকে যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তা দেখে বিস্মিত হয়েছে খোদ পুলিশ। কেন এত হিংসা সেটি নিয়ে অনুসন্ধান করছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
পুলিশের অপরাধ তদন্ত সংস্থা-সিআইডির ক্রাইম সিনের কর্মকর্তারা আলামত সংগ্রহ করেছেন। মরদেহ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়েছে।
প্রাথমিক তথ্য সংগ্রহের পর বাহিনীটির ধারণা, এই খুনে জড়িত সীমার সৎ ছেলে এম এম আশিকুর রহমান নাহিদ।
নাহিদের বাবা শাহজাহান সিকদার, মামা নাসির উদ্দিন, স্ত্রী জাকিয়া সুলতানা আইরিন, শ্বশুর আশেক উল্লাহ, শাশুড়ি রোকেয়া বেগম, শ্যালক সাকিবকেও সন্দেহের তালিকায় রেখেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীটি।
নাহিদ রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের বিবিএর শিক্ষার্থী। ঘটনার পর থেকে তিনি আত্মগোপনে আছেন।
কাফরুল থানা পুলিশ জানিয়েছে, এরই মধ্যে কয়েকজনকে আটক করা হয়েছে। তবে তারা কারা, সেটা এখনই বলতে চাইছে না বাহিনীটি।
পুলিশ জানায়, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে শাহজাহান সিকদারের দ্বিতীয় স্ত্রী হিসেবে ঘরে আসেন সীমা বেগম। সৎ মাকে মেনে নিতে পারছিলেন না নাহিদ। এ নিয়ে সংসারে নানা ঝামেলাও হয়েছে।
এই বাড়িতেই কুপিয়ে ও আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়েছে সীমা বেগমকে। ছবি: নিউজবাংলা
নাহিদের মা মারা যাওয়ার পর গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের সীমা বেগমকে বিয়ে করেন শাহজাহান। তার বাড়ি পাশের জেলা ফরিদপুরের আলফাডাঙ্গায়।
হত্যার দিন বা আগের দিন কী নিয়ে ঝামেলা হয়েছিল, তা নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
সীমার বড় ভাই হেলাল শরীফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার বোনকে ও (নাহিদ) দেখতে পারত না। ওরা মেরে ফেলছে।’
সীমা বেগমের খালাতো বোন মাহমুদ সৈয়দ বলেন, ‘ওর (সীমা) শরীরের অনেকগুলো ছুরির আঘাত ছিল। লুঙ্গি দিয়ে গলা প্যাঁচানো ছিল। এরপর পোড়াইয়া মারছে। আমরা এর বিচার চাই।’
ওই বাড়ির সপ্তম তলায় থাকতেন সীমা। তার নিচের তলায় থাকেন হান্নান হাওলাদার। তিনি জানান, বেলা ১১টার দিকে তিনি সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠার সময় নাহিদের স্ত্রী, শ্বশুর ও শ্যালককে নিচে নামতে দেখেন।
হান্নান জানান, এই পরিবারে সমস্যা হচ্ছে, এই বিষয়টি তারা আগেই জেনেছেন। আর ফ্ল্যাট মালিক সমিতি সেই সমস্যা সমাধানের জন্যও বলেছিল।
তিনি বলেন, ‘আমি বাইরে ছিলাম। নাহিদের শ্বশুর আমাকে কল দিয়ে নিয়ে আসছে। উনি তার মেয়েকে নিয়ে চলে যাচ্ছিলেন। আমি আটকাইছি। বলেছি কী ঝামেলা হইছে, সমাধান করেন। মেয়ে নিয়ে যাবেন কেন?’
হান্নান জানান, তিনি ঘরে গিয়ে নাহিদের শ্বশুরকে তার বাসায় যেতে বলেন সমাধানের জন্য।
কিছুক্ষণ পর নাহিদের শ্বশুর এসে হান্নানকে জানান, নাহিদদের ফ্ল্যাটের ভেতর থেকে দরজা খুলছে না কেউ। ডাকলেও সাড়া দিচ্ছে না।
এর মধ্যে নাহিদের বাবা শাহজাহান শিকদারও বাইরে থেকে বাসায় আসেন। মিরপুরে তার কার্টনের কারখানা আছে। তিনি ডাকাডাকি করলেও দরজা ভেতর থেকে কেউ খুলছিল না। চাবি দিয়ে খোলার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। সিটকিনি আটকানো ছিল ভেতর থেকে।
তখন অন্যদের সঙ্গে নিয়ে দরজা ভাঙা হয়। ভেতরে ঢুকে সবাই দেখে পশ্চিম দিকে মাথা রাখা অবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে আছেন সীমা বেগম। মরদেহে তখনও আগুন। পানি এনে সে আগুন নেভানো হয়।
এটা স্পষ্ট যে, ভেতরে সীমা ছাড়াও আর কেউ না কেউ ঘরে ছিল। নইলে সিটকিনি লাগানো থাকার কথা না। তবে সেটা কে, সে বিষয়ে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া যায়নি।
সন্ধ্যায় বাসায় গিয়ে দেখা যায়, ফ্লোরে রক্তের দাগ। পানি দেয়ার কারণে রক্তের রঙ অনেকটাই হালকা। লিফটহীন বাসায় মরদেহটি নিচে নামানোর কারণে গোটা সিঁড়িতেই পানিমিশ্রিত রক্তের ফোঁটা ফোঁটা দাগ দেখা গেছে।
কাফরুল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সেলিমুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের তদন্ত চলছে। নিহতের ভাই মামলা করবেন। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে।’