১৯৬৮ সালে নুরুল ইসলাম সরকার যখন গাইবান্ধা শহরের পুরাতন বাজারে ছোট দোকানে তার হোমিওপ্যাথির চেম্বার খোলেন, তখন এক ‘পুরিয়া’ (ছোট চিরকুটে ভাঁজ করা প্যাকেট) ওষুধের দাম নিতেন পাঁচ পয়সা। সেই থেকে তার নাম হয়ে যায় ‘পাঁচ পাই ডাক্তার’। তার আসল নাম আড়ালে পড়ে যায়। এ নামেই কয়েক জেলার মানুষ গত ৫২ বছর ধরে তাকে চেনে।
নূরুল ইসলামের বয়স এখন ৯১ বছর পেরিয়েছে। এখনও তিনি একই নামে পরিচিত। যদিও পাঁচ পয়সা অচল। এখন ওষুধের দাম বেড়ে যাওয়ায় ৫ টাকা থেকে ৩০ টাকা পর্যন্ত নেয়া হয়।
এই বয়সেও নুরুল বাড়ি থেকে বের হন হেঁটে। লাঠিতে ভর করে যান আধা কিলোমিটার রাস্তা। পরে ইজিবাইক কিংবা রিকশাভ্যানে পৌঁছান গাইবান্ধা শহরের পুরাতন বাজারের চিকিৎসালয়ে।
সিরিয়াল অনুযায়ী আন্তরিকতার সঙ্গে রোগীদের সমস্যার কথা শুনে দেন ওষুধ। জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত করে যেতে চান মানুষের সেবা। আর এভাবেই লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে তিনি জয় করেন মানুষের মন।
নুরুল ইসলামের বাড়ি গাইবান্ধা সদর উপজেলার খোলাহাটি ইউনিয়নের পশ্চিম কোমরনই গ্রামে।
নিজের সম্পর্কে এ চিকিৎসক বলেন, ‘১৯৫০ সালে মেট্রিক পরীক্ষা দেয়ার পর আমি বেকার ছিলাম। একটা কাপড়ের দোকানে কিছুদিন কাজ করেছি। সে সময় শরৎচন্দ্র ভট্টাচার্য নামে এক হোমিও চিকিৎসকের কাছে অসুখ-বিসুখে চিকিৎসা নিতাম। তখন থেকে হোমিও চিকিৎসার চটি বই কিনে প্রাথমিক ধারণা নেই।
‘এরপর নিজেই অসুখে ওষুধ খেতাম। রোগ সারত। বিনা মূল্যে প্রতিবেশীদের ওষুধ দিলে সেটিও কাজ করত। পরে বাজার থেকে আরও বই কিনে পড়াশোনা করি। এভাবে আস্তে আস্তে রোগী আসা শুরু হয়।’
নুরুল এ বিদ্যায় এমনই হাত পাকিয়ে ফেলেন যে, তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। স্রোতের মতো রোগী আসতে থাকে দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে। একটা পর্যায়ে দিনে তিন শতাধিক রোগী ভিড় করে তার চেম্বারে। বর্তমানে এ চিকিৎসকের পরামর্শ নিচ্ছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরাও।
সদর উপজেলার দাড়িয়াপুর থেকে আসা আবু সাইদ নামে এক রোগী নিউজবাংলাকে বলেন, “আমি এর আগেও ‘পাঁচ পাই ডাক্তারের’ চিকিৎসা নিয়েছি। উনার চিকিৎসা খুবই ভালো। এ জন্য আবার এসেছি।”
চিকিৎসা নিতে আসা মোমেনা বেগম নামে এক নারী বলেন, “জন্মের পর থেকেই ‘পাঁচ পাই ডাক্তারের’ নাম শুনে আসছি। তিনি আমার দাদারও বড়। তার চিকিৎসা ভালো জন্যেই সবসময় তার কাছেই আসি। রোগের বিষয় যদি এই চিকিৎসককে ভালোভাবে বুঝিয়ে বলা যায়, তাহলে জটিল রোগও সারে।”
সুন্দরগঞ্জের কঞ্চিবাড়ি গ্রামের নুরুল আমিন তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছেন। রংপুর ও ঢাকাসহ অনেক ডাক্তার দেখিয়েছেন। কিন্তু রোগ সারেনি। এবার ভরসা ‘পাঁচ পাই ডাক্তার’।
নুরুল ইসলামের বড় ছেলে জহুরুল হক সরকার রাজাও একজন হোমিও চিকিৎসক। তিনি এখন চেম্বার দেখাশোনা করেন। বাবার অনুপস্থিতিতে চালিয়ে নেন চিকিৎসা সেবা।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উত্তরসূরি হিসেবে আমরা তার সম্মান অক্ষুণ্ন রাখার চেষ্টা করছি।’
‘পাঁচ পাই ডাক্তার’ শুধু চিকিৎসার মধ্যে নিজেকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। দোকান কর্মচারী থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য হয়েও করেছেন জনসেবা।