নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা ছয় মাসের মধ্যে নিষ্পত্তির বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু নির্ধারিত সময়ে বেশিরভাগ মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে সাক্ষীর অর্থনৈতিক অবস্থা, ট্রাইব্যুনাল অনুযায়ী অতিরিক্ত মামলার চাপ, মেডিক্যাল টেস্ট করাতে পরিবারের অনীহা, পুলিশ সদস্যদের বদলিসহ নানা কারণ রয়েছে।
শনিবার রাজধানীর কারওয়ান বাজারে একটি জাতীয় পত্রিকার মিলনায়তনে ‘১৮০ দিনের মধ্যে মামলা নিষ্পত্তির নির্দেশনা কতটুকু মানছি আমরা: প্রসঙ্গ নারীর ও শিশু নির্যাতন মামলা’ বিষয়ক গোলটেবিল বৈঠকে এ কথা বলেন বক্তারা।
আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের আয়োজনে এবং ক্রিয়েটিং স্পেসেস টু টেক অ্যাকশন অন ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইমেন অ্যান্ড গার্লস’ প্রকল্পের আওতায় গ্লোবাল অ্যাফেয়ার্স কানাডা ও অক্সফামের সহযোগিতায় এই বৈঠক হয়।
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এ ধারা ২০(৩) এ বলা হয়েছে, মামলা হওয়ার তারিখ থেকে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে ট্রাইব্যুনালে বিচার কার্যক্রম শেষ করতে হবে।
২০১৬ সালের ৫ ডিসেম্বর বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম এবং বিচারপতি জে বি এম হাসানের সমন্বয়ে গঠিত ডিভিশন বেঞ্চে নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ২০০০ এর আওতায় সব মামলা ট্রাইব্যুনাল ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে একটি মনিটরিং সেল গঠনের নির্দেশনা দেন।
কিন্তু অনেক মামলার ক্ষেত্রে এই নির্দেশনা মানা হচ্ছে না। আমরাই পারি জোটের পক্ষ থেকে কিছু মামলার উদাহরণ দেয়া হয়।
এর মধ্যে দিনাজপুরে পাঁচ বছরের শিশু পূজা ধর্ষণের মামলা অন্যতম। চার বছরে নিষ্পত্তি হয়নি এই মামলা। বিচার কার্যক্রম আছে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে।
অন্যদিকে গত অক্টোবরে বাগেরহাটের এক শিশু ধর্ষণের মামলায় মাত্র সাত কার্যদিবসে রায় দেয়ার নজিরও সৃষ্টি হয়েছে।
বক্তাদের একজন বলেন, ‘দুটি ঘটনা তুলনা করে বোঝা যাচ্ছে, নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা চাইলেই ১৮০ দিনের মধ্যে নিষ্পত্তি করা সম্ভব।’
সভার প্যানেল আলোচক সিনিয়র সহকারী বিচারক আখতারুজ্জামান বলেন, ‘বাগেরহাটের মামলা নিষ্পত্তিতে বিচার বিভাগের প্রতিটি সেক্টরের মধ্যে সমন্বয় ছিল। এ কারণে মামলার কার্যক্রম দ্রুত শেষ করা সম্ভব হয়েছে।’
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের অ্যাসিস্ট্যান্ট অ্যাটর্নি জেনারেল ফারহানা আফরোজ বলেন, ‘তদন্তে বিলম্ব, ভুল রিপোর্ট প্রদান, মেডিক্যাল রিপোর্ট পেতে ধীরগতিসহ নানা কারণ ছয় মাসের মধ্যে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলা নিষ্পত্তির পথে অন্তরায়।’
অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি পুলিশের প্রতিনিধি হিসেবে সোহেল রানা জানান, প্রতিটি থানায় নারী শিশু প্রতিবন্ধীদের জন্য স্পেশাল ডেস্ক রয়েছে এবং প্রায় ৬৯১২টি ফেসবুক পেইজ থেকে নিয়মিত নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে তথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, অনেক থানাতেই দ্রুত তদন্ত রিপোর্ট দেয়া হচ্ছে। তবে সময়মত স্বাক্ষী হাজির না করা ও ডাক্তারি পরীক্ষায় পরিবারের অনীহায় পুলিশের কাজে বিঘ্ন ঘটায়।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ড. মিজানুর রহমান তার বক্তব্যে অপরাধী বিচার করার পাশাপাশি নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশুর মানসিক, আর্থিক, সামাজিক পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে সরকারকে আহ্বান জানান।
সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজ গোলাম কিবরিয়া নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলায় স্বাক্ষীদের সময়মতো হাজির না হওয়ার পেছনে স্বাক্ষীর অর্থনৈতিক অবস্থাকে অন্যতম কারণ বলে মনে করেন।
তিনি আশা করেন, রাষ্ট্র যদি স্বাক্ষীর যাতায়াতের খরচ বহন করে সেক্ষেত্রে অনেক স্বাক্ষীই সঠিক সময়ে হাজির থাকবে।
গোলাম কিবরিয়া আরও বলেন, 'ট্রাইবুনালের সংখ্যা অনুযায়ী অতিরিক্ত মামলার চাপ থাকায় ১৮০ দিনের সময়সীমা মেনে চলা সম্ভব হয়ে উঠছে না।
তাই ট্রাইব্যুনালের সংখ্যা বৃদ্ধি ও এই অনুযায়ী বাজেট ব্যবস্থাপনার ওপর তিনি গুরুত্ব দেন।
আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের নির্বাহী সমন্বয়কারী জিনাত আরা হকের সঞ্চালনায় সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান, বিশেষ অতিথি ছিলেন গোলাম কিবরিয়া (সিনিয়র জেলা ও দায়রা জজের পরিচালক), সোহেল রানা (বাংলাদেশ পুলিশের এআইজি), মাহফুজা আক্তার মালা।