রাজধানীতে দুই দিনে তিনটি বস্তিতে আগুন। পুড়েছে এক হাজারের বেশি ঘর। সহায় সম্বল হারিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় স্বল্প আয়ের মানুষ।
এই ঘটনাগুলো একেবারেই বিরল নয়। শহরাঞ্চলে বেঁচে থাকার জন্য নিত্য সংগ্রাম করা মানুষগুলো বারবার নিঃস্ব হচ্ছে এ ধরনের ঘটনায়।
এগুলো দুর্ঘটনা নাকি নাশকতা এ নিয়ে বিতর্ক পুরনো। ইচ্ছে করে আগুন দেয়ার অভিযোগ একাধিকবার করেছেন ক্ষতিগ্রস্ত বস্তিবাসী।
প্রতিটি ঘটনার পর কমিটি হয়, তদন্ত হয়। কিন্তু প্রকাশ্যে আসে না প্রতিবেদন। কী সুপারিশ, সেটাও জানা যায় না।
তবে ফায়ার সার্ভিসের প্রধান জানিয়েছেন, তাদের তদন্তে দেখা গেছে, এই আগুনের জন্য বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী বিদ্যুতের অবৈধ ও অনিরাপদ সংযোগ। গ্যাসের ত্রুটিপূর্ণ সংযোগের দায় দ্বিতীয়।
কিন্তু এই দুটি সমস্যার সমাধান করা যায়নি। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা অজুহাত দেখায় কর্মী স্বল্পতায়, আর গ্যাস বিতরণ সংস্থা এ নিয়ে কথাই বলতে চায় না।
বাহিনীটির সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজধানীর বস্তিগুলোতে আগুন লাগার ঘটনা ১২৩টি। ক্ষতি হয়েছে কমসে কম ১২ কোটি ৯২ লাখ টাকা।
একই বস্তিতে আগুন লাগে একাধিকবার। গড়ে প্রতিটি বড় বস্তি পুড়েছে দুই বার।
স্বভাবতই এগুলোতে বসবাস ছিন্নমূল মানুষদের। কয়েক বছরের চেষ্টায় গড়া কিছু সম্পদ আর সঞ্চয় চলে যায় নিমেষে।
পরে আবার শূন্য থেকে শুরু; ঋণের জালে জড়ানো। এ যেন নিয়তি হয়ে গেছে বস্তিবাসীর।
কী বলছে ফায়ার সার্ভিস
ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালক সাজ্জাদ হোসাইন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বস্তিগুলোতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের অবৈধ ও অনিরাপদ সংযোগগুলোই বারবার আগুন লাগায়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে একটি বিদ্যুতের লাইন থেকে অনেকগুলো ঘরে বিদ্যুৎ সরবরাহ হওয়ায় শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়। আরও আছে অরক্ষিত গ্যাস লাইন।’
এই কর্মকর্তা বলেন, ‘বস্তিতে আগুন নিয়মিত ঘটনা হলেও ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হয় না। কারণ এত ঘনবসতির কারণে আগুনের কেন্দ্রবিন্দু পর্যন্ত সময়মতো পৌঁছানো যায় না। সেই সঙ্গে পানির স্বল্পতা তো থাকেই।’
বস্তিগুলোতে পরিকল্পিত বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবারহ নিশ্চিত করা না গেলে এ ধরনের দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা সম্ভব নয় বলেও মনে করেন ফায়ার সার্ভিস প্রধান।
প্রকাশ্যে আলোচনা নেই
প্রতিবারের আগুনের ঘটনায় কারণ ও ক্ষতি নির্ধারণে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে গঠিত হয় তদন্ত কমিটি। কমিটি যাচাই-বাছাই করে ভবিষ্যৎ দুর্ঘটনা রোধে করণীয় নিয়ে সুপারিশ করে। তবে সেগুলো নিয়ে কখনও প্রকাশ্য আলোচনা হয়নি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে নিউজবাংলাকে জানান, প্রতিবেদনগুলো সংশ্লিষ্ট দফতরে পাঠানো হয় সুপারিশ বাস্তবায়নের জন্য। এগুলো সাধারণদের জন্য প্রকাশ করা হয় না।
তিনি বলেন, সুপারিশে অধিকাংশ সময় গ্যাস ও বিদ্যুতের সুরক্ষিত ও নিরাপদ বিপণনের কথা উল্লেখ থাকে, যার দায়িত্ব বর্তায় ওই দুটি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর।
বিদ্যুৎ বিতরণ বিভাগের বক্তব্য
কথা হয় রাজধানীর বিদ্যুৎ বিপণন সংস্থা ডিপিডিসির তেজগাঁও জোনের উপসহকারী প্রকৌশলী মাহবুব চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘তদন্ত কমিটির দেয়া সুপারিশ বাস্তবায়নে আমরা নিয়মিত প্রচেষ্টা চালাই। বস্তিগুলোতে মূল চ্যালেঞ্জ হলো অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা। দেখা যায়, প্রায় সকল বাড়িওয়ালাই তাদের বৈধ মিটারের সংযোগ তারের আগে হুক দিয়ে জোড়া দিয়ে অসংখ্য অবৈধ লাইন নিয়ে যায় তাদের ভাড়াটিয়ার ঘরে। এতে যেমন সরকার রাজস্ব হারায়, তেমনি এই অরক্ষিত সংযোগগুলো থেকে শর্ট সার্কিট হয়ে অগ্নিকাণ্ড ঘটে।’
‘তাহলে আপনারা করেন কী?’
জবাবে এ প্রকৌশলী বলেন, ‘কয়েক দিন পরপরই আমরা সকল অবৈধ লাইন কেটে তার নিয়ে আসি। সঙ্গে জরিমানাও আদায় করি। কিন্তু পরে আবার নিজস্ব টেকনিশিয়ান দিয়ে অবৈধ লাইন টেনে নেয়।’
বিদ্যুৎ বিপণন সংস্থার কর্মী ছাড়া সংযোগ নেয় কীভাবে, এমন প্রশ্নে মাহবুব চৌধুরী বলেন ‘আগে আমাদের সংস্থায় এই ধরনের কর্মচারী থাকলেও এখন আর সে সুযোগ নেই। বস্তিবাসী নিজেরাই এ ধরনের কাজ করে থাকে।’
স্থায়ীভাবে অবৈধ সংযোগগুলো বিচ্ছিন্ন হয় না কেন জানতে চাইলে ডিপিডিসির কর্মকর্তা বলেন লোকবল সংকটের কথা।
তিনি বলেন, ‘আমরা চার থেকে পাঁচ জন যাই মনিটর করতে। সেখানে জোর খাটাতে গেলে বস্তিবাসী আমাদের উপর চড়াও হয়। আপনারা তো বিভিন্ন সময় শুনেই থাকেন আমদের ওপর হামলার ঘটনা।’
একই বিষয়ে জানার চেষ্টা করলে তিতাস গ্যাসের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল কেউ কথা বলতে রাজি হননি।
বস্তিগুলোর নিয়মিত আগুনকে নিছক দুর্ঘটনা হিসেবে দেখতে নারাজ স্থপতি ইকবাল হাবিব। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এমন ঘটনার পর প্রথমেই বিদ্যুৎ ও গ্যাস সরবারহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জবাবদিহিতার আওতায় আনা উচিত। কারণ কোথায় অবৈধ, অরক্ষিত সংযোগ আছে, তা খুঁজে বের করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার দায়িত্ব তাদেরই।’
নিম্ন আয়ের মানুষগুলোর নিরাপদ আবাসনের জন্য সরকারি-বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ নেয়ার দাবি করেছেন এই নগর পরিকল্পনাবিদ।
সরকারের এই ধরনের চিন্তা অবশ্য আছে। গত সংসদ নির্বাচনের আগে একাধিক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী জানান, তিনি বস্তিবাসীর জন্য বহুতল ফ্ল্যাট করে দেবেন। সেখানে মাসিক, সাপ্তাহিক ও দৈনিক ভাড়াতে থাকা যাবে। তবে এখনও এই ফ্ল্যাটগুলো হয়নি।