করোনার সময়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেখানেই যান, মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। চলছে ‘নো মাস্ক-নো সার্ভিস’ নীতি।
মাস্ক এখন একপ্রকার পোশাক হয়ে গেছে; হয়ে গেছে ফ্যাশনের অংশ।
সুন্দর দেখাতে, মনের ভাব প্রকাশে কিংবা অনেক সময় প্রতিবাদের ভাষা বোঝাতেও ব্যবহার হচ্ছে মাস্ক।
ফ্যাশন ডিজাইনাররা বলছেন, মানুষ জামার সাথে ম্যাচিং করে টিপ পরে, চুড়ি পরে। যে জিনিসটি মুখের অর্ধেক অংশ ঢেকে রাখে সেটিকে কেন না ফ্যাশনেবল করা হবে না? অনেক ফ্যাশন হাউজ জামার সাথে এখন ম্যাচিং করে মাস্কও দিচ্ছে।
সাধারণ মানুষের জন্য কাপড়ের মাস্কই ভালো, এমন কথা বিশেষজ্ঞদের। সেই কাপড়ের মাস্কে জমে উঠেছে আবার নকশার বৈচিত্র্য।
সুন্দর দেখাতে নকশা মাস্ক
দেশজ সংস্কৃতি আর ঐতিহ্য যেমন আসছে মাস্কে, তেমনি বৈশ্বিক ধারার আধুনিক নকশাও দেখা যাচ্ছে। রিকশা পেইন্টিংয়ের থিম যেমন রয়েছে, তেমনি সুপারহিরো থিমও বাদ যায়নি।
জামদানি প্রিন্ট, গামছা প্রিন্টসহ অন্যান্য ধাঁচের প্রিন্ট রয়েছে বাজারের মাস্কে। রয়েছে পলকা ডট, চেক, ডোরাকাটা নকশাসহ নানা প্যাটার্নের ব্যবহার। মোম বাটিকও মিলবে। ফুল, প্রজাপতি, মোমবাতি, পতাকার ‘থিম’ সবই উঠে আসছে এখনকার মাস্কে।
কেউ পছন্দ করেন ভেজিটেবল ডাই। কেউ চান একরঙা মাস্ক। কেউ চান ‘করপোরেট লুক’। পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্ক বেছে নিতে পারেন।
শিশুদের পছন্দসই রঙিন ফুল-ফল, গাড়ি কিংবা কার্টুন চরিত্রভিত্তিক মাস্কও পাওয়া যায়। কোথাও আবার মাস্ক পাওয়া যায় পুরো পরিবারের সব সদস্যের সঙ্গে মিলিয়ে, যাতে শিশুরা অভিভাবকদের মতো মাস্ক পরতে উৎসাহ পায়।
মুখের আকার অনুযায়ী মাস্কের আকার বেছে নেওয়ার সুযোগ থাকছে কোথাও কোথাও। আবার মাস্কের পেছনের অংশ সুবিধাজনক উপায়ে ‘ফিট’ করার বা সামঞ্জস্য রাখার ব্যবস্থাও থাকতে পারে। শিশুর বয়স ও মুখের গঠনভেদে ভিন্ন আকারের মাস্ক প্রয়োজন হয়।
রাজধানীর ধানমন্ডিতে রবীন্দ্র সরোবরে বন্ধুদের সাথে বেড়াতে এসেছেন তাহমিনা হক। সুতি কাপড়ের মাস্কে আবার লতাপাতার ডিজাইন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, আমরা মেয়েরা যারা লিপস্টিক দিতাম, তারা তো এখন সেটা দিতে পারছি না। সেক্ষেত্রে কালারফুল মাস্ক হলে দেখতে ভালো লাগে। আর কাপড়টা তো নরম, পরেও আরাম পাওয়া যায়।’
লেকের আরেকপাশে বন্ধুক নিয়ে বেলুন শ্যুট করছেন মিতুশি খন্দকার। সুতি কাপড়ের মধ্যে ডিজাইন করা মাস্ক। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখন তো মুখ পুরোপুরি ঢেকে থাকে। সেজে এসেও লাভ নাই। ডিজাইন করা মাস্ক থাকলে ছবি তুললে সুন্দর লাগে।’
তিনি জানান, ড্রেসের সাথে ম্যাচিং করে তার সাতটি মাস্ক আছে।
‘জামার সাথে ম্যাচিং করেই পরি আসলে। সাত-আটটা মাস্ক আছে এখন পর্যন্ত, যেগুলা জামার সাথে ম্যাচিং করে কিনেছি। একটা আবার জামার সাথে ফ্রি পেয়েছি।’
সাশ্রয়ী মূল্যে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়
করোনার শুরু থেকে সার্জিক্যাল মাস্ক, এন-৯৫, কেএন-৯৫ এর চাহিদা অনেক বেশি ছিল। এন-৯৫ কিংবা কেএন-৯৫ এর যে দাম, তা অনেকেই বহন করতে পারে না। আবার কম দামে পেলেও সার্জিক্যাল মাস্ক ব্যবহারের হ্যাপাও কম নয়। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, সার্জিক্যাল মাস্ক একবার মুখ থেকে সরিয়ে ফেললে আবার তা পরা উচিত নয়। সেদিক থেকে ধুয়ে একাধিকবার পরার সুবিধার পাশাপাশি ফ্যাশনের জন্যে সুতির নকশা-করা মাস্কগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন অনেকে।
সবুজ রঙের কটন কাপড়ের উপর হাতে আঁকা জবা ফুলের মাস্ক পরা অফিসগামী মারজিয়া জাহান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্জিক্যাল মাস্কের দাম কম হলেও ওভারঅল চিন্তা করলে দাম আসলে বেশি পরে। কারণ সার্জিক্যাল মাস্ক একটা একবারের বেশি পরা যায় না। সেক্ষেত্রে ১৫০ টাকা দিয়ে কটনের মাস্ক কিনলে সেটা ধুয়ে দীর্ঘদিন পরা যায়। আর দেখতেও আসলে রুচিশীল, পরেও আরাম।’
জামদানি নকশার কাজ করা মাস্ক পরে হেঁটে যাচ্ছিলেন এনজিওকর্মী মোশরেফ রিফাত। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘মাস্ক এখন আর অপশনাল কিছু না, এটি এখন এসেনশিয়াল জিনিস হয়ে গেছে। তাই সুন্দর রুচিশীল মাস্ক পরলে নিজেকে দেখতে ভালো লাগে, কনফিডেন্স বাড়ে।
‘এই ধরুন আমি ঘড়ি পরি। সব ঘড়িই সময় দেখায়। তবে, আমরা কিন্তু ঘড়ি চয়েস করে কিনি। মাস্কও ঠিক তাই। দেখেশুনে বাছাই করে কেনার সুযোগ থাকলে কেন নয়।’
অভিব্যক্তি অনুযায়ী মাস্ক
বাংলার জনপ্রিয় অভিনেতা জসীম হুংকার দিয়ে আছেন – এমন একটি রিকশা পেইন্টিংয়ের মাস্ক ব্যবহার করেন সাদ্দিফ অভি।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘এই মাস্কটাতে তিনটি লেয়ার ব্যবহার করা হয়েছে, যা বাজারের অন্য মাস্কের তুলনায় ভালো মনে হয়েছে আমার কাছে।’
জসীমের হুংকার দেয়া প্রিন্ট দিয়ে তিনি বোঝাতে চেয়েছেন, মাস্ক না পরলে সাজা ভোগ করতে হবে। তিনি বলেন, ‘আবার এই মাস্ক পরাতে অনেকেই আমাকে খেয়াল করে। তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করে। এতে করে তারাও মাস্ক পরার জন্য উৎসাহ পাবে বলে আমি মনে করি।’
প্রেমিকার সাথে দেখা করতে পার্কে বসে আছেন তাবিদ রায়হান। মুখে কালো রঙের মাস্ক। নীল রঙ্গে লেখা ‘ক্ষ্যাপা’।
তিনি বলেন, ‘গার্লফ্রেন্ডের সাথে ঝগড়ার পর আজ ১৭ দিন বাদে দেখা হচ্ছে। আমি রেগে আছি বুঝাইতেই এই মাস্কে ক্ষ্যাপা পড়ছি। আমি নিজেই আঁকাআঁকি করি। অনেকেই এমন কাস্টমাইজড মাস্ক কেনে। এক রঙের মাস্ক কিনে সেটাতে চাহিদা অনুযায়ী এঁকে দিই।’
ফ্যাশনের জন্য দেখছেন না মূল্য কত
চাহিদা অনুযায়ী মাস্ক তৈরি করে দেয় এমন একটি প্রতিষ্ঠি ‘সূর্যপ্রভা’র প্রধান এলিনা ত্রিপুরা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অভ্যাস নাই বলে অনেকেই মাস্ক পরতে চায় না। সুন্দর নকশার মাস্ক মানুষকে মাস্ক পরতে অভ্যস্ত করে তোলে। এই ভাবনা থেকেই কাস্টমাইজড মাস্ক তৈরির কথা মাথায় আসে।
‘মাস্ক কেবল মুখে সেঁটে থাকা একটা আবরণ নয়, মুখোশের আড়ালের মানুষটির পরিচয়, আবেগ-অনুভূতি, জীবনভাবনা, ভালোবাসাকে ধারন করে থাকার গল্প হয়ে উঠতে পারে এই মুখোশ।’
অনলাইন বিক্রি ছাড়াও বিভিন্ন ফ্যাশন হাউজগুলোতেও বিক্রি হচ্ছে মাস্ক। ফ্যাশন হাউস ‘ইয়োলো’-তে বিক্রি হচ্ছে নানানরকম মাস্ক। প্রতিষ্ঠানটির জিগাতলা শাখার বিক্রয় ব্যবস্থাপক জানান, এখন মাস্কই তাদের সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া আইটেম। ৭০, ১২৫ ১৪৫, ১৪৫, ৩৯৫ ও ৮৯৫ টাকার মাস্ক রয়েছে।
ফ্যাশন ডিজাইনার লায়লা আঞ্জুমান নিউজবাংলাকে বলেন, মানুষ নিজেকে সুন্দর দেখাতে নানান রকম আয়োজন করে। যার যার সামর্থ্য অনুযায়ী মানুষ এই খাতে ব্যয় করে। তাই দামের কথা কেউ মাথায় রাখে না।
তিনি বলেন, ‘ফ্যাশন আসলে সময়ের সাথে পরিবর্তনশীল। আর যে জিনিসটা মানুষ বেশি ব্যবহার করে সেটাকে ঘিরেই ফ্যাশন তৈরি হয়। এক সময় হাতে গোণা কিছু মানুষ মাস্ক পরত। তাও বিশেষ কারণে। এখন সেটা সবার জন্য বাধ্যতামূলক।’
সাধারণ মানুষের জন্য কাপড়ের মাস্ক ভালো
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য বিভাগের পরিচালক আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশিদ আলম বলেন, ‘এখন মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নয়। তাই যেটা ধুয়ে ব্যবহার করা যাবে তেমন মাস্কই আসলে ভালো। সার্জিক্যাল মাস্ক একবার মুখ থেকে খোলার পর আবার না পরার জন্যই আমরা বলি। সে ক্ষেত্রে একজন মানুষকে দৈনিক অনেক মাস্ক কিনতে হবে। তার থেকে কাপড়ের মাস্কগুলো ধুয়ে দীর্ঘদিন ব্যবহার করা যায়।’