জামিল মিয়া, রায়হান উদ্দিন ও বন্ধুরা থাকে মিরপুরের চলন্তিকা বস্তিতে। কোনো বস্তিতে আগুন লাগল কি না, সে খবর তাদের কাছে পৌঁছে যায় মুহূর্তে।
যে আগুনে ঘরহারা মানুষদেরকে দিশেহারা করে দেয়, সেটিই আবার জামিল-রায়হানদের আয়ের সুযোগ এনে দেয়।
ক্ষতিগ্রস্তদের মতো তারাও ধ্বংসস্তুপে খুঁজতে থাকে মূল্যবান জিনিসপত্র।
সর্বশান্তরা হতাশ হলেও আগুন কখনও হতাশ করে না জামিল-রায়হানদের। প্রত্যাশিত লোহার পেরেক, তামা, চুম্বক সব সময় পেয়ে যায় তারা।
মঙ্গলবার রাতে আগুনে পুড়েছে মিরপুরের কালশী বস্তি। পরদিন সকালে সেখানে হাজির এই কিশোররা।
একটি পোড়া দোকান থেকে প্রত্যাশিত জিনিসপত্র খুঁজে বের করতে দেখা গেল চার বন্ধুকে। পুড়ে ছাই হওয়া জিনিসপত্রের মধ্যে কোনটা লোহা, কোনটা চুম্বক কোনটা তামা, তার পরীক্ষা চলছিল।
জামিল বলে, ‘লোহা, প্যারেক, নাট, তামা, চুম্বক খুঁজি। সব পুইড়া কালা। হের লাইগ্যা টিনে লাগায় দেখি চুম্বক কিনা।’
রায়হান জানায়, তারা লোহাজাতীয় যা কুড়িয়ে পান, তা ২১ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। তবে তামা আর চুম্বকের দাম বেশি। আর এ জন্য কাউকে টাকা দিতে হয় না, ফলে যাওয়া আসার আর খাবার খরচ বাদ দিলে পুরোটাই থাকে পকেটে।
রায়হান বলে, ‘আগের দিন বিহারি ক্যাম্পে গেছিলাম। আইজ সকালে গেছি মহাখালীরটায়।
‘বছরে কয়েকবার তো আগুন লাগেই। একটা বস্তিত আগুন লাগে, ঘর পুড়ে, আমরা এক একজন পাঁচশ থেকে হাজার ট্যাকা পাই। তয় জামিল বেশি পায়।’
জামিল কেন বেশি পায়?
সে বলে, ‘আমি তো সিনিয়র, আমার অভিজ্ঞতা বেশি। হেরা নতুন।’
এই কিশোর বলে, ‘এই ব্যবসায় লস নাই। আমি এদের শিখাইছি এই ব্যবসা। আমি বুঝি কোন দোকানে কী পাওয়া যাইব। তাই বেশি মাল পাই। ওরা নতুন, কয়দিন পর ওরাও বুঝব।’
কীভাবে বোঝে সে?
জবাব এল ‘এই ধরেন, এই দোকানটা হইল ডেকোরেটরের। আমি আইয়াই আগে জাইনা লইছি কোনডা কোন দোকান। ডেকোরেটরের দোকানে সাউন্ডবক্স থাহে। চুম্বক তামা বেশি থাহে।’
এই টাকা দিয়ে কী করো-জানতে চাইলে রায়হান বলে, ‘নতুন জামা-প্যান্ট কিনি। কোনোডা আবার ঈদের লাইগ্যা রাইখা দেই।’
জামিল বলে, ‘আমি খালি নিজের লাইগ্যা না, ছোট বইনের লাইগ্যাও কিনি।’
যত রাতই হোক, আগুন লাগার খবর পেলেই সেখানে চলে যায় রায়হান-জামিলরা।
গত সপ্তাহে আয় ভালো হয়েছে এই কিশোরদের। দুই দিনের ব্যবধানে আগুনে পুড়েছে তিনটি বস্তি। আবার মহাখালীর টিঅ্যান্ডটি কলোনির দোকান ঘরও পুড়েছে একদিন।
সোমবার রাত পোনে বারোটায় আগুন লাগে রাজধানীর মহাখালীতে সাততলা বস্তিতে। পরদিন বিকেল সোয়া চারটায় আগুন লাগে মোহাম্মদপুরের বিহারী ক্যাম্পের পাশে জহুরি মহল্লাতে। সেদিন রাতের দেড়টার দিকে আগুন লাগে কালশীর সি ব্লকে। কয়েকশ ঘর আর দোকান পুড়ে যায়।
আয় ভালো হলেও আগুনে নিঃস্ব মানুষদের দেখে খুবই মন খারাপ হয় জামিল রায়হানদের।
জামিল বলে, ‘আমাগো ট্যাকা পয়সা বন্ধ হইলে যদি আগুন না লাগে, তাইলে তাই অউক। কত মাইনষেরে কানতে দেহি, মন খারাপ অয়। আমরাও তো বস্তিতেই থাহি। ডর লাগে। কোনসম জানি আবার নিজের সব হারায়।’