‘নাচনেওয়ালা পুতুলটার একখান ঠ্যাং পাইছি খালি। হইলদা (হলুদ) নতুন জামাডাও গেছে গা পুইড়া।’
শান্ত স্বরে কথাগুলো বলছিল ঝিমলি।
মহাখালী সাততলা বস্তির আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তার শখের পুতুল।
গত সোমবার রাত পৌনে বারোটায় আগুন লাগে মহাখালী সাততলা বস্তিতে। ৫০ টি ঘর নিমেষে পুড়ে ছাই। সেই ছাইয়ে পাওয়া গেছে ঝিমলির পুতুলের একটি আধপোড়া পা।
ঘর হারিয়ে এখন পথে পুরো পরিবার। তবে ঝিমলির মূল কষ্ট তার পুতুলকে ঘিরে।
বলে, ‘আমার ঝুম্মু (পুতুল) নিমুরা নিমুরা গান গাইত আর নাচত। ওর জামা আমি বানাইতাম। গোসল করাইতাম, খাওয়াইতাম।’
ঝিমলির মা সালেহা বানু। বলেন, ‘দুদিন ধইরা মেয়ে খায় না, কথা কয় না।’
ঝিমলি বলে, ‘ওরে যেইহানে কবর দিছিলাম, অনে এহন বস্তা আইনা থুইছে। ঝুম্মুরে না আনলে খামু না।’
বাবা রমজান আলি বলেন, ‘মাইয়াডার ছোট থেকেই বুদ্ধি কম। কবিরাজ দেখাইছি, লাভ হয় নাই। থাকার জায়গা নাই, খাওন নাই, সেগুলা বুঝে না, পুতুল নিয়া কী করে!’
তিনি বলেন, ‘হাসপাতালের সামনে এক মাইয়ার কাছে এমন নাচে যে পুতুল সেইডা দেইখা তারও শখ হইছে। মেয়ে বায়না ধরছিল বইলা রাতে গ্যারেজের মালিকরে বইলা দুই তিন ঘণ্টা বেশি রিকশা টানছি। ১৯০০ টাকা দিয়া পুতুলডা কিইন্যা দিছি।
‘এখন ঘর, জিনিস সব শেষ। খাওনের টাকাই নাই। পুতুল আইনা দিই কইত্তে কন দেহি।’
সাততলা বস্তির পরই আগুন লাগে মোহাম্মদপুরের বাবর রোডের বিহারি ক্যাম্পের পাশে জহুরি মহল্লার বস্তিতে। মঙ্গলবার বিকেল সোয়া চারটার দিকে আগুন লাগার খবর শুনে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট দেড় ঘণ্টার চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। ততক্ষণে দুইশর বেশি ঘর পুড়ে ছাই।
সেই আগুনে ঘর হারানো ইসমত মোল্লা। তিন মেয়ে এক ছেলে নিয়ে তার সংসার। স্ত্রী আকলিমা বেগম দুবাইয়ে কাজ করতে গিয়ে আর ফেরত আসেনি।
বলেন, ‘আমার পায়ে সমস্যা। কাম কাজ তেমন করতে পারি না। দেশে যা ছিল সব বেইচা বউরে দুবাই পাঠাইছি। চারমাস টাকা দেয়ার পরতে এখন আর দেয় না। খোঁজও নাই। অইখানে এক ভাতিজা থাকে। দুই বছর পর কইল, আকলিমা দুবাইয়ে খুলনার এক লোকরে বিয়া করছে আল্লাহ সাক্ষী রাইখা।
‘এহন আর কী করার, মেয়েপোলা নিয়া কোনো রকম ছিলাম। আগুনে সব নিলোগা। কপালই খারাপ।’
সাততলা, জহুরি মহল্লার পরেই আগুন লাগে কালশী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ‘সি ‘ ব্লকের বস্তিতে। রাত দেড়টার দিকে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে ভোর ছয়টায়। দোকানসহ ৫০ টির বেশি ঘর পুড়ে যায়।
সেই আগুনে ঘর, দোকান দুটিই হারিয়েছে লালমতি। ৭৫ এর কাছাকাছি বয়সী এই বৃদ্ধা তিন নাতনিকে নিয়ে থাকতেন এখানে।
কালশী বস্তির লালমতির স্বপ্ন ছিল নাতনির জন্য রিকশা গ্যারেজ রেখে যাবেন। কিন্তু পুড়ে গেছে আগুনে।
মারা যাওয়ার আগে গ্যারেজের দোকান রেখে গিয়েছে স্বামী। তার ভাড়া দিয়ে চলত সংসার।
বলেন, ‘আমি দুদিন পর চোখ বন্ধ করাম। নাতনিদের নিয়া চিন্তায় বাঁচি না।’