আসিয়া বেগমের অভাবের সংসার। নিজে করেন গৃহকর্মীর কাজ। তার স্বামী রিকশাচালক। দুই জনের যা আয় তা দিয়ে কোনোরকমে চলে সংসার। একমাত্র মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন বছর চারেক আগে।
আর একমাত্র ছেলেকে নিয়ে তারা থাকতেন রাজধানীর মিরপুরের কালসির বি-বাড়িয়া বস্তিতে। মঙ্গলবার গভীর রাতে আগুন লেগে ভস্ম হয়ে গেছে তাদের ঘর। কোনোরকমে আগুন থেকে বাঁচাতে পেরেছেন তিনটি বড় ছাগল। কিন্তু পুড়ে মরে গেছে ছাগলের একটি ছানা। আরেকটি ছানাও ঝলসে গেছে।
পাঁচ বছর আগে খুলনার গ্রামের বাড়ি থেকে রাজধানীতে এসেছিলেন আসিয়ারা। স্বপ্ন ছিল মেয়েটার একটা ‘ব্যবস্থা’ করার। তাই ছেলে-মেয়ে নিয়ে ওঠেন কালসির ওই বস্তিতে। নিজ শুরু করেন গৃহকর্মীর কাজ। আর স্বামী চালাতে শুরু করেন রিকশা। এভাবে বছর খানেক চলার পর কিছু টাকা জমা করেন মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য।
আসিয়া বেগম নিউজবাংলাকে জানান, জমা করা টাকায় মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিলেন না। তাই গ্রামের বাড়ির কিছু জমিও বিক্রি করেন। সেই টাকা দিয়ে ২০১৬ সালে মেয়েকে বিয়ে দেন এক রিকশাচালকের সঙ্গে। যিনিও ভাড়া করা রিকশা চালাতেন।
মেয়ের বিয়ের সময় আসিয়া চিন্তা করেছিলেন জামাইকে রিকশা কিনে দেবেন। কিন্তু মেয়েকে বিয়ে দিয়ে যে টাকা ছিল তা দিয়ে রিকশা কেনা যাচ্ছিল না। তখন তার মাথায় আসে ছাগল পালনের কথা। যে ছাগল বেচে মেয়েজামাইকে রিকশা কিনে দেবেন। এজন্য প্রথমে একটি পুরুষ ছাগল কেনেন।
এরপর মেয়ের সুখের কথা ভেবে খেয়ে, না খেয়ে বছর খানেকের মধ্যে একটি মেয়ে ছাগল কেনেন ছানাসহ। সেই ছাগল থেকে গত তিন বছরে আরও চার সদস্য এসেছে। যার মধ্যে দুটি বিক্রি করে দিয়েছেন আসিয়া।
সবমিলে আসিয়াদের ছিল তিনটি বড় ছাগল ও সাত মাস বয়সী দুটি ছানা। যে ছানা দুটির একটি মঙ্গলবার রাতের আগুনে মারা গেছে, আরেকটি গেছে ঝলসে।
বুধবার সকালে পোড়া বস্তিতে কথা হয় আসিয়া বেগমের সঙ্গে।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, সবকটি ছাগলই তাদের ঘরে ছিল। আগুন লাগার পর বড়গুলোকে ভালোমতো বের করতে পারলেও বাচ্চা দুটি নিয়ে পড়েন বিপাকে। বাচ্চা দুটোই উল্টো আগুনের দিকে দৌড় দেয়। একটিকে কোনোমতে উদ্ধার করতে পারেন। আরেকটি রাতে আর খুঁজে পাননি। সকালে সেটির পোড়াদেহ দেখতে পান।
আসিয়া বেগম যে ছানাটি উদ্ধার করতে পারেন আগুনে সেটির পশম পুড়ে গেছে; দুই কান ঝলসে গেছে। হলুদ গুঁড়া দিয়ে সেটির চিকিৎসা দিচ্ছেন আসিয়া, রাখছেন কোলে কোলে।
‘ঘর পোড়ায় যে কষ্ট পাইছি, তারচেয়ে বেশি কষ্ট পাইছি ছাগলের বাচ্চা দুটোর জন্য। একটা তো মরেই গেল। আরেক বাঁচবে কিনা জানি না। তাই কোলে কোলেই রাখছি’, বলেন আসিয়া।
তিনি জানান, আগুন থেকে বেঁচে যাওয়া বড় ছাগল তিনটি একটু দূরে ‘নিরাপদ স্থানে’ রেখে এসেছেন। পুড়ে যাওয়া বাচ্চাটা নিয়ে পোড়া বস্তিতেই আছেন। সকালে খিদে আর যন্ত্রণায় ছটফট করেছে ছানাটি। তারপর দোকান থেকে প্যাকেটজাত তরল দুধ কিনে আনেন। বোতলে ভরে খাওয়ানোর পর কিছু স্বাভাবিক হয়েছে বাচ্চাটি।
পোড়া বাচ্চাটি নিয় হাসপাতালে যাচ্ছেন না কেন- জানতে চাইলে আসিয়া বলেন, ‘মানুষেরই কোনো চিকিৎসা পাওয়া যায় না, এটা তো বোবা প্রাণী, এদের চিকিৎসা কই পাব?’
তিনি জানান, মার্চে করোনার সংক্রমণ শুরু হওয়ার পর মাস দুয়েক তিনি কাজ করতে পারেননি। তার স্বামীর আয়ও কমে গিয়েছিল। তা না হলে আর মাস ছয়েকের মধ্যেই বড় ছাগলগুলো বিক্রি করে মেয়েজামাইকে রিকশা কিনে দিতে পারতেন তারা।