বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

তাজরীনের গেটে তালা দিয়ে ‘হত্যা’

  • নিউজবাংলা ডেস্ক   
  • ২৪ নভেম্বর, ২০২০ ০৮:১৮

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর রাতে পোশাক কারখানায় আগুন লাগার পর শ্রমিকরা কাজ থেকে ওঠার চেষ্টা করলেও তাদের ধমকে বসিয়ে দেয়া হয়। পরে যখন উঠতে দেয়া হয়, তখন দেরি হয়ে গেছে। আবার একটি গেটে তালাও ঝুলিয়ে দেয় মালিকপক্ষ। এ কারণে ১১৪ জনের মৃত্যুকে দুর্ঘটনা নয়, হত্যা বলছেন শ্রমিক নেতারা।

সাভারের আশুলিয়ার তাজরীন ফ্যাশনের বেঁচে থাকা শ্রমিকরা জানাচ্ছেন, আগুন লাগার বিষয়টি তারা টের পেয়ে নিরাপদে বের হওয়ার চেষ্টা করেও পারেননি। কারণ কারখানা কর্তৃপক্ষ তাদের বারবার বলেছে, প্রশিক্ষণ চলছে; কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এমনকি গেটে তালাও ঝুলিয়ে রেখেছে।

শ্রমিকদের তখনই কাজ ছেড়ে উঠতে দেয়া হয়, যখন আর সিঁড়ি দিয়ে বের হওয়ার সুযোগ ছিল না।

২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর ওই দুর্ঘটনায় ১১৪ জন শ্রমিকের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রশাসন। চার-পাঁচ তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে কত শত শ্রমিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছেন, এটা নিশ্চিত করে বলতে পারছেন না কেউ।

এ ঘটনায় করা অবহেলাজনিত হত্যা মামলাটি এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এটিও শ্রমিকদের ক্ষোভের একটি কারণ। আবার পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ না পেয়ে অনেক পরিবার আছে কষ্টে।

বেঁচে ফেরার বিষয়টি এখনও বিশ্বাস হয় না খোরশেদ আলম রবিন ও ফাতেমা খাতুন দম্পতির। একই কারখানায় কাজ করতেন।

চতুর্থ তলায় অপারেটর পদে কাজ করতেন ফাতেমা। পঞ্চম তলায় কোয়ালিটি কন্ট্রোলার পদে ছিলেন রবিন।

দুজনের বিয়ের সবে ছয় মাস। স্বামী-স্ত্রী কাজ শেষে একসঙ্গে ফিরতেন বাসায়।

রবিন জানান, পৌনে সাতটার দিকে অ্যালার্ম বেজে উঠার পর তারা নামার চেষ্টা করেন। তখন কর্মকর্তারা বলেন, প্রশিক্ষণ চলছে, কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

কিছুক্ষণ পর পুরো ফ্লোর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। তখন তারা সিঁড়ি দিয়ে নামার চেষ্টা করেন। কিন্তু আগুনের কারণে পারছিলেন না। একটি সিঁড়িতে আবার কর্তৃপক্ষ তালাই মেরে দিয়েছিল।

এর মধ্যে কোনো রকমে চার তলায় এসে স্ত্রীর খোঁজ করেন রবিন। বলেন, ‘প্রচণ্ড ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে পারছিলাম না। সঙ্গে আগুনের তাপ। সেদিন বুঝতে পারছিলাম, মৃত্যু হয়তো বা এখনই এসে পড়েছে। স্ত্রী আর পরিবারের সবার কথা মনে পড়ছিল। ভাবছিলাম আর বাঁচব না।’

ধোঁয়া আর হুড়োহুড়ির কারণে স্ত্রীকে খুঁজে পাননি রবিন। পরে আবার পাঁচ তলায় ফিরে যান তিনি। ওই ফ্লোরের জানালা ভেঙে পাশের ভবনের ছাদে লাফিয়ে পড়ে গুরুতর আহত হন।

ফাতেমা খাতুন কার কারণে বেঁচে ফিরেছেন এখনও জানেন না। তিনি বলেন, ‘রাত আটটায় ছুটি হওয়ার কথা ছিল। আমরা কাজ করতেছিলাম। সন্ধ্যার দিকে তিন বার হর্ন বেল বাজার পরে আমরা উঠতে লইছি। তখন খবির বস আর ময়মনসিংহের ফ্লোর ইনচার্জ রঞ্জু ছিল। উনারা বলছে, তুমরা উইঠো না। এখানে কিছু হয় নাই।’

বারবার শ্রমিকরা উঠতে চাইলেও তাদের গালাগাল করা হয়। ফাতেমা বলেন, ‘একে একে দুই-তিনবার এমনে উটতে লইছি। তারা বসায় দিছে; গালাগাল শুরু করছে।’

যখন নির্দেশ অমান্য করে কাজ থেকে উঠেন ফাতেমারা, তখন দেরি হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ‘আগুন অনেক ছড়ায় গেছিল। আমরা আর নামতে পারলাম না। নিচের মেয়েদের গেট দিয়া গেলাম। হেটাও আমরা নামতে পারি নাই। আমি পড়ি গেছি।’

কার বদান্যতায় বেঁচেছেন, সেটা আট বছরেও জানেন না ফাতেমা। ওই লোকটা বেঁচে আছে না মারা গেছে, সেটাও প্রশ্ন হয়ে রইল তার কাছে।

ফাতেমা বলেন, ‘তখন আমার ছয় মাসের বাচ্চা পেডে ছিল। কে যেন আমারে উঠায় নিছে আমি বলতে পারলাম না। পরে উপরে গিয়া পাশের বিল্ডিংয়ের ওরা বাঁশ বাইন্ধা দিছে ওই দিক দিয়া নিচে নামি।

‘পইড়া যাইয়া সাইরা আমি অসুস্থ হইয়া গেছি। আমার পায়ে কাইটা গেছে, কোমড়ে ব্যথা পাইছি। এখনও পায়ে যন্ত্রণা করে। আর ওই দিনের কতা মনে হইলে ভয় পাই।’

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটা মালিকের অবহেলা। কারণ ওই দিন কারখানার কলাপসিবল গেট বন্ধ ছিল। এটা কোনো দুর্ঘটনা না, এটা হত্যা, যার কারণে এত মানুষের মৃত্যু কোনোভাবেই মেনে নেয়ার মতো না।’

ক্ষতিপূরণের দাবি

রবিন-ফাতেমা দম্পতি বিদেশি একটি এনজিও থেকে পাঁচ লাখ টাকা পেয়েছিলেন। কিন্তু বাড়ি ভাড়ার বকেয়া পরিশোধ আর একটি ব্যবসা করার চেষ্টায় লোকসানের পর কিছুই থাকেনি।

রবিন এখন শাক ও অল্প কিছু মৌসুমি ফল বিক্রি করেন। আগে দুজন আয় করতেন। এখন এক জন করেন যৎসামান্য। স্বভাবতই সংসারের চাকা ঘোরে তো ঘোরে না।

তখন গর্ভে থাকা মেয়ে নূরে জান্নাতের বয়স এখন আট। সাত বছর পর হয় আরেক কন্যা। এখন বয়স ১১ মাস। সন্তানদের ভরণপোষণ ও লেখাপড়া নিয়ে দুশ্চিন্তায় এই দম্পতি।

গার্মেন্ট শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের সাংগঠনিক সম্পাদক খাইরুল মামুন মিন্টু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আট বছর পার হয়ে গেলেও তাজরীনের আহত শ্রমিকদের পুনর্বাসনে সরকার বা বিজিএমইএর পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি। চিকিৎসার ব্যবস্থাও করা হয়নি।’

শ্রমিকদের আর্থিক সহায়তার ব্যাপারে এই শ্রমিক নেতা বলেন, ‘প্রথম দফায় লিংকথিংক নামে একটা বায়ার ১০০ শ্রমিককে ১ লাখ করে টাকা দিয়েছিল। সেটা তারা বিজিএমইএর মাধ্যমে দিয়েছিল। ওটাকে বিজিএমইএ তাদের সাহায্য হিসেবে বলার চেষ্টা করেছিল।’

এরপর ২০১৬ সালে তাজরিন ক্লেইম অ্যাডমিনিস্ট্রেশন কমিটি শ্রমিকদের সহায়তা করে। তখন নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে দেয়া হয়েছিল। কিন্তু আহত শ্রমিকরা প্রকৃতপক্ষে এক থেকে আড়াই লাখ টাকা করে পেয়েছে।

তবে ক্ষতিগ্রস্ত সবাই এই ক্ষতিপূরণ পায়নি। ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসনের দাবিতে ৭০ দিনেরও বেশি সময় ধরে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান করছে ক্ষতিগ্রস্ত ৪৫ শ্রমিক।

শ্রমিক নেতা মিন্টু এ বিষয়ে বলেন, শ্রমিককল্যাণ ফাউন্ডেশন নামে শ্রমিকদের সহায়তা করার জন্য সরকারের বড় ফান্ড আছে। এখানে কোটি কোটি টাকা জমা আছে। এই তহবিল থেকে শ্রমিকদের সহায়তা দেয়ার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে শুনেছেন; কিন্তু কিছুই হয়নি।

এ বিভাগের আরো খবর