পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য হাজী মোহাম্মদ সেলিমের বেদখল করা শত কোটি টাকার জমি উদ্ধার করে এক সপ্তাহও রাখতে পারল না অগ্রণী ব্যাংক।
ব্যাংকের নির্মাণ সামগ্রী সরিয়ে জমিতে স্ত্রীর মালিকানা দাবির সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দিয়েছেন হাজী সেলিম। সীমানা প্রাচীরের ফটকে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে তালা।
ব্যাংকের কর্মকর্তারা ভয়ে জমিতে যাচ্ছেন না। নিউজবাংলাকে তথ্য জানালেও নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করেছেন বারবার।
বিষয়টি স্থানীয় থানাকে জানালে তারা ব্যবস্থা না নিয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে মামলা করার পরামর্শ দিয়েছে। যদিও এ নিয়ে আগে থেকেই মামলা চলছে। আর এর মধ্যেই শক্তি দেখিয়ে জমিটি দখল করেন হাজী সেলিম।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকেই জমিটি সে সময়ের হাবিব ব্যাংকের ছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর হাবিব ব্যাংক ও কমার্স ব্যাংক একীভূত করে গঠন করা হয় অগ্রণী ব্যাংক। আর সেখানেই করা হয় ব্যাংকটির শাখা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই শাখার উদ্বোধন করেন। সেখানে তার একটি ব্যাংক হিসাবও ছিল।
ওই জমিতে জায়গা সংকুলান না হওয়ায় পরে ব্যাংকটির শাখা পাশের একটি ভবনে সরিয়ে নেয়া হয়। আর এই জমিতে নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়।
ব্যাংক কর্মকর্তারা জানান, ২০০৩ সালে স্ত্রী গুলশান আরা বেগমের নামে জমিটি দখলে নেয়ার চেষ্টা শুরু করেন হাজী সেলিম। সে সময় এর একটি দলিলও বানান তারা। আর জায়গা না ছাড়ায় ব্যাংক কর্মকর্তাদের হুমকিও দেয়া হয়।
এরপর ব্যাংক কর্তৃপক্ষ আদালতে মামলা করে। সেই মামলা এখনও চলছে।
চলতি বছরের মার্চে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ দেখা দেয়ার পর ব্যাংকের কার্যক্রম অনেকটাই স্থবির হয়ে পড়ে। এই সুযোগে হাজী সেলিমের লোকজন জায়গাটি দখল করে। তারা বুলডোজার দিয়ে পুরনো ভবন গুঁড়িয়ে দিয়ে সীমানা প্রাচীর তুলে দেয়।
এই ঘটনায় গত ২০ মে চকবাজার থানায় লিখিত অভিযোগ করেন ওই শাখার দায়িত্বে থাকা সহকারী মহাব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডল। ১৫ জুন র্যাব-৩ এর কাছেও অভিযোগ দেন তিনি।
সে সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কোনো ব্যবস্থা না নিলেও গত ২৬ অক্টোবর নৌ বাহিনীর কর্মকর্তাকে মারধরের মামলায় হাজী সেলিমের ছেলে ইরফান সেলিমকে গ্রেফতারের পরদিন জমিটি উদ্ধার করে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে বুঝিয়ে দেয়া হয়।
তবে ৪ নভেম্বর রাতে আবার হাজী সেলিমের লোকজন জমিটি দখল করে নেয় বলে জানিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ।
ব্যাংকের গড়ে তোলা সীমানা প্রাচীর গুঁড়িয়ে দিয়ে প্রবেশদ্বারে তালা ঝুলিয়ে দিয়েছে স্থানীয় সংসদ সদস্যের লোকজন। গেটে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। তাতে জমির মালিক হিসেবে হাজী সেলিমের স্ত্রী গুলশানারা বেগমের নাম লেখা রয়েছে।
প্রতিদিন পালা করে সাত থেকে আট জন পাহারা দিচ্ছেন জমিটি। ব্যাংকের কর্মকর্তারা জমির ধারেকাছে যেতে পারছেন না।
নিজেদের দখল ফিরে পেয়ে অগ্রণী ব্যাংক স্থাপনা নির্মাণের জন্য যেসব নির্মাণ সামগ্রী রেখেছিল, সেগুলোও সরিয়ে নিয়েছে হাজী সেলিমের লোকজন।
এ ঘটনার পর ৫ নভেম্বর চকবাজার থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেছে অগ্রণী ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। র্যাবকেও চিঠি দেয়া হয়েছে।
তবে এসব নিয়ে জানতে চাইলে মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডল কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ব্যাংকটির অন্য একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ করে বলেন, ‘এই জমিটির সঙ্গেই ব্যাংকটির বর্তমান শাখা। সেখানে হাজী সেলিমের লোকজন প্রতিদিন পাহারা দেয়। তাদের কারণে ব্যাংকের কর্মীরা সেখানে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। কিন্তু পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।’
‘এই কারণে আমাদের পক্ষে নাম প্রকাশ করে গণমাধ্যমে কিছু বলাও সম্ভব নয়’, কেন পরিচয় জানাতে রাজি হন না, তার ব্যাখ্যা দিলেন এই কর্মকর্তা।
ছেলে গ্রেফতারের পর আপাতদৃষ্টিতে চাপে পড়ার পর হাজী সেলিমের দখলের বিষয়ে সে সময় খোলাখুলিই কথা বলেছিলেন ব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডল।
ওই এলাকায় প্রতি শতক জমির দাম সাড়ে চার থেকে পাঁচ কোটি টাকা। ফলে এই জমির দাম হয় প্রায় শত কোটি টাকা।
সরকারের জমি দখল করে নেয়ার বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ সাধারণ ডায়েরি করার পরও ব্যবস্থা না নেয়ার কারণ জানতে চাইলে চকবাজার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মওদূত হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অগ্রণী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে দেওয়ানি মামলা করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। থানা থেকে তাদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হবে বলে আশ্বস্ত করা হয়েছে।’
দখল নিয়ে হাজী সেলিম পক্ষের বক্তব্য
এ বিষয়ে হাজী মোহাম্মদ সেলিমের মোবাইল ফোনে কল করা হলে ফোন ধরে তা কেটে দেয়া হয়। পরে একাধিকবার কল করলেও সেটা ধরা হয়নি।
২৬ অক্টোবর বাড়িতে র্যাবের অভিযানের সময় এক অর্থে উধাও হয়ে যাওয়া হাজী সেলিম গত ৩ নভেম্বর পুরান ঢাকায় জেল হত্যা দিবসের কর্মসূচিতে উপস্থিত হন। এরপর জনসম্মুখে দেখা যাচ্ছে না তাকে।
পরে হাজী সেলিমের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মদিনা গ্রুপের উপমহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম, ল্যান্ড প্রকিউরমেন্ট) নুরুল হামিদের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, ‘উনাদের কাছে (অগ্রণী ব্যাংকের) কোনো কাগজপত্র নেই। আমরা চ্যালেঞ্জ করছি উনারা একটা কাগজ দেখাক। আমরা যে মালিকের কাছ থেকে জমি কিনেছি, তার প্রমাণ আছে, জমির খাজনাও আমরা পরিশোধ করেছি।’
কার কাছ থেকে কত টাকা দিয়ে কিনেছেন, এটা বলতে পারেননি হামিদ। বলেছেন, ‘এটা কাগজপত্র দেখে বলতে হবে। এখন নামাজে দাঁড়িয়েছি।’ এরপর ফোন কেটে দেন তিনি।
এই কর্মকর্তা ফোন কেটে দেয়ায় আদালতে মামলা থাকা জমি শক্তি দেখিয়ে দখল করার বিষয়ে প্রশ্ন করা যায়নি।
২০০৩ সালে প্রথম জমিটি স্ত্রীর বলে দাবি করেন হাজী সেলিম। ওই জমির দলিল রয়েছে তার কাছে। কিন্তু ব্যাংকের দাবি, ওই দলিল ভুয়া।
অগ্রণী ব্যাংকের মৌলভীবাজার শাখার ব্যবস্থাপক বৈষ্ণব দাস মণ্ডল নিউজবাংলাকে বলেছিলেন, ‘১৯৪৭ সালের পর থেকে জমিটি হাবিব ব্যাংকের দখলে ছিল। দেশ স্বাধীনের পর অগ্রণী ব্যাংকের দখলে আসে জমিটি। তারা (হাজী সেলিম) যে মালিকদের কাছ থেকে কিনেছে বলেছেন, তাদের তো পাওয়া যায়নি।
‘ব্যাংক মামলা করেছে জমির মালিকানা দাবি করে। মামলা উচ্চ আদালতে প্রক্রিয়াধীন। অগ্রণী ব্যাংক রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক। এর জমিও মূলত সরকারের।’
হাজী সেলিমের যত দখল
পেশিশক্তি দেখিয়ে ছেলে গ্রেফতারের পর পুরান ঢাকায় হাজী সেলিমের দখলের বিষয়টি আবার সামনে এসেছে।
ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগ নতুন নয়। বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে সরকারি জমি দখল করে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছিলেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে বিআইডব্লিউটিএ অভিযান চালিয়ে সেই অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে।
সাবেক জগন্নাথ কলেজের একাধিক ছাত্রাবাস হাজী সেলিমের দখলে বলেও অভিযোগ আছে।
ঢাকা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের অর্পিত সম্পতি শাখার তথ্য বলছে, বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ের বেদখলে থাকা ১২টি হলের মাঝে সবচেয়ে বড়টি ছিল ‘তিব্বত হল’। ২০০১ সালে হলের অবকাঠামো পরিবর্তন করে তার স্ত্রীর নাম অনুসারে স্থাপনাটির নাম রাখেন ‘গুলশান আরা সিটি মার্কেট’। ছাত্রাবাস উদ্ধারের দাবিতে শিক্ষার্থীরা কয়েক বছর ধরে নানা কর্মসূচিও পালন করে আসছেন।
ঢাকা সরকারি বধির হাই স্কুলের নামে বরাদ্দ করা জমিও হাজী সেলিম দখল করে নিয়েছেন বলে স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিযোগ করেছে। এ ছাড়া ব্যক্তি পর্যায়ে আরও অনেক সম্পত্তি দখলের অভিযোগ পুরনো।
ক্ষমতাসীন দলের সংসদ সদস্যের দখল ঢাকা ছাড়িয়ে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁওয়ের মেঘনাঘাট এলাকাতেও পৌঁছেছে। সেখানে হাজী সেলিমের মদিনা গ্রুপের একটি সিমেন্ট কারখানা করা হচ্ছে।
এই প্রকল্পের জন্য ১৪ একর সরকারি খাস জমি দখল করেন হাজী সেলিমের লোকজন। গত ১ ও ৫ নভেম্বর অভিযান চালিয়ে সে জমি উদ্ধার করে স্থানীয় প্রশাসন।
নারায়ণগঞ্জ ফতুল্লার পিলকুনি এলাকায় চার বছর আগে একটি পরিবারের জমি দখল করে তাকে পানিবন্দি করে রাখেন হাজী সেলিম। এ নিয়ে মামলার পর গত ৩ নভেম্বর ফতুল্লা সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) আজিজুর রহমান ওই পরিবারের পক্ষে রায় দেন।
সাখাওয়াত হোসেন নামে একজনকে জমি বিক্রি করতে চাপ দিয়ে আসছিলেন হাজী সেলিম। তিনি তা বিক্রি করতে রাজি না হওয়ায় তার ১৫ শতক জমির মধ্যে পাঁচ শতক দখল করে নেন। আর জমি বিক্রি করতে চাপ দিতে তার বাড়ি পানিবন্দি করে রাখার অভিযোগ উঠে।