কুমারগাঁওয়ে গ্রিড লাইনে দুর্ঘটনার ৩১ ঘণ্টা পর সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু হয়েছে ধীরে ধীরে। এতে মিলেছে স্বস্তি। কিন্তু কেমন ছিল গত এক দিনের জীবন?
বাতি জ্বলেনি, কলে ছিল না পানি, হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা ছিল সীমিত, অস্ত্রোপচার বন্ধপ্রায়, মোবাইল ফোনের চার্জ দেয়াও অনিশ্চিত, ফলে বিপদে পড়লে উদ্ধার করতে কাউকে ডাকবেন, সে সুযোগও ছিল সীমিত।মঙ্গলবার সকাল সাড়ে নয়টার দিকে কুমারগাঁওয়ে গ্রিড লাইনে আগুনের পর পুরো একটি দিন বিদ্যুৎহীন সিলেটে জীবন হয়ে যায় কঠিন। ফ্রিজে রাখা খাবার নষ্ট হয়ে যাচ্ছিল, রান্নাও অনিশ্চিত হয়ে যায়। হঠাৎ চাহিদা বাড়ে মোমের, গুণতে হয় বাড়তি অর্থ। বড়রা পরিস্থিতি বুঝতে পারলেও শিশুদেরকে মানানো কঠিন। প্রবীণদের জন্যও কষ্টকর। এই পরিস্থিতিতে বুধবার সকাল থেকেই নগরীর অনেক বাসিন্দাকে বাসা ছেড়ে গ্রামের বাড়িতে চলে যেতে দেখা গেছে।বুধবার সন্ধ্যার পর কিছু কিছু এলাকায় বিদ্যুৎ আসার পর আশাবাদী হয়ে উঠে অন্য এলাকার বাসিন্দারা। তবে বিদ্যুৎ বিভাগ জানিয়েছে, সব এলাকায় বিদ্যুৎ ফিরতে সময় লাগবে আরও।হাসপাতালে বিঘ্নিত সেবা বিদ্যুৎহীনতার কারণে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সীমিত পরিসরে চলছে প্যাথলজির পরীক্ষা। এতে সেবাপ্রার্থীরা পড়েছেন বিপাকে। নগরীর জিন্দাবাজার থেকে হাসপাতালে আসা রোগী আনিস মিয়া বলেন, ‘রোগ নির্ণয়ে আজ মূত্র পরীক্ষার কথা ছিল। কিন্তু হাসপাতালে থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে। এখন ক্লিনিকে পরীক্ষা করাতে খরচ হবে বাড়তি টাকা।’ সিলেটে এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের উপপরিচালক হিমাশু লাল রায় বলেন, ‘বিদ্যুৎহীনতার কারণে আমাদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে বিকল্প ব্যবস্থায় আমরা জরুরি সেবাগুলো চালু রেখেছি। গুরুতর রোগী ছাড়া অন্যদের প্যাথলজি পরীক্ষা করা যায়নি। তবে জরুরি বিভাগ বর্হিবিভাগ এবং ওয়ার্ডের কার্যক্রম স্বাভবিক রয়েছে।’
ভেঙে পড়েছে পানি সরবরাহ ব্যবস্থাপানি সংগ্রহে নগরীর বিভিন্ন গভীর নলকূপে লাইন ধরে পানি সংগ্রহ করছেন অনেকে। দুপুরে নগরীর মদিনা মার্কেট এলাকায় একটি গভীর নলকূপ ঘিরে শতাধিক নারী-পুরুষের ভিড় দেখা যায়। কলস-বালতিসহ নানা পাত্রে নিয়ে পানি সংগ্রহ করতে আসেন তারা।পানি নিতে আসা বাগবাড়ি এলাকার বাসিন্দা অমূল্য দাস বলেন, ‘মঙ্গলবার থেকে বাসায় পানি নেই। দোকান থেকে কিনে নিয়ে পানি খাচ্ছি। কিন্তু রান্না-বান্না, গোসলসহ অন্যান্য কাজের জন্য পানি নিতে এসেছি।’একই নলকূপ থেকে পানি নিতে আসা গৃহকর্মী আরিফা খাতুন বলেন, ‘এ নিয়ে তিন বার পানি নিতে এসেছি। প্রায় এক কিলোমিটার দূর থেকে পানি নিতে হচ্ছে। আজকের মধ্যে বিদ্যুৎ না আসলে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে।’নগরীর মিরাবাজার কাস্টঘর চালিবন্দরসহ বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় গভীর নলকূপ ঘিরে পানি নিতে আসা নারী-পুরুষের দীর্ঘ লাইন। ট্রাকে ভ্যানে করেও পানি বিক্রি করছেন অনেকে। আবার কেউ কেউ মানবিক উদ্যোগে পাড়ায় পাড়ায় পানি বিলি করে যাচ্ছেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাহী প্রকৌশলী আলী আকবর চৌধুরী জানান, ‘নগরীরবাসীর দুর্ভোগ বুঝতে পারছি। আমরা নিজেরাও দুর্ভোগে আছি। কিন্তু বিদ্যুতের কাছে আমরা অসহায়। বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু না হলে পানি বিতরণ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে না।’ বিপর্যস্ত মোবাইল সেবাবিদ্যুৎহীনতায় মোবাইল চার্জ দিতে পারছেন না নগরবাসী। এমন পরিস্থিতিতে কয়েকটি এলাকায় টাকার বিনিময়ে মোবাইল ফোন ও চার্জারলাইটে চার্জ দেয়া হচ্ছে। দাম বেড়েছে মোমবাতিরও।দক্ষিণ সুরমাকুচাই এলাকায় বিকাশ এজেন্টের দোকানে চার্জ দিতে এসে মঙ্গলবার স্থানীয় আব্দুর রশিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকাল থেকে বিদ্যুৎ নেই। ফলে মোবাইল ফোনেরও চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এ কারণে ৫০ টাকা দিয়ে এখানে চার্জ দিতে এসেছি।’দোকান মালিক সেবুল আহমদ বলেন, ‘বিদ্যুৎ না থাকায় জেনারেটরের মাধ্যমে দোকান খোলা রেখেছি। জেনারেটরের তেলের খরচ জোগাতে চার্জ দেয়ার বিনিময়ে টাকা নিচ্ছি।’নেটওয়ার্ক সমস্যার কারণে কথা বলতে সমস্যা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নগরবাসী। তারা বলছেন, কথা বলতে গেলেই কল ড্রপ হচ্ছে। বারবার ফোন করেও লাভ হচ্ছে না।জেনারেটরের দোকানে ভিড়নগরীর বিভিন্ন জেনারেটর মেরামতের দোকানে হঠাৎ ব্যস্ততা বেড়েছে। অনেকই পুরনো ও নষ্ট জেনারেটর মেরামত করতে নিয়ে আসছেন। নগরীর জল্লারপাড় এলাকায় এমন একটি দোকানে জেনারেটর নিয়ে এসেছেন দারিয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা আকমল হোসেন। তিনি বলেন, ‘বাসায় আইপিএস আছে। তাই দীর্ঘ দিন নষ্ট হয়ে পড়ে থাকলেও এই জেনারেটর সারানো হয়নি। কিন্তু গতকাল রাতে আইপিএসের চার্জ শেষ হয়ে গেছে। এদিকে বাসায় অসুস্থ বৃদ্ধ ও শিশুরা রয়েছে। তাই বাধ্য হয়ে জেনারেটর মেরামত করতে এসেছি।’শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র বন্ধ বিমানবন্দরে বিদ্যুৎ বন্ধের কারণে ফ্লাইট উঠানামায় সমস্যা হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সিলেট আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপক হাফিজ আহমেদ। তবে সেবা বিঘ্নিত হচ্ছে বলে স্বীকার করেছেন।তিনি বলেন, ‘আমাদের শক্তিশালী জেনারেটর রয়েছে। বিদ্যুৎতের বিকল্প জেনারেটর দিয়ে কাজ চালিয়েছে সিলেটে যেহেতু শীত কিছুটা শুরু হয়ে গেছে তাই আমরা এসি বন্ধ রেখেছি।কী বলছে বিদ্যুৎ বিভাগবিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক করতে আগুনে পুড়ে যাওয়া জাতীয় গ্রিড লাইনের যন্ত্রগুলো সংস্কারের কাজ চলছে। তবে সংস্কার শেষ হতে কতক্ষণ লাগতে পারে এখনও নিশ্চিত করে জানাতে পারেননি তারা।
আগুনে দুটি ট্রান্সমিটার একটি ফিড একটি কন্ট্রোল প্যানেল পুরো পুড়ে গেছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্টরা। পুড়ে যাওয়া ট্রান্সমিটারগুলোর বদলে ঢাকা থেকে নতুন দুটি ট্রান্সমিটার নিয়ে আসা হচ্ছে। বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থা পাওয়ার গ্রিড কোম্পানির উপসহকারী প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘আমাদের সংস্কার কাজ মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। পিডিবির কাজ শেষ হলেই আমরা সীমিত আকারে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করতে পারবো।’সিলেটের বিদ্যুৎ উন্নয়ন ও বিতরণ বিভাগের প্রধান প্রকৌশলী খন্দকার মোক্কামেল হোসেন বলেন, ‘আমার দ্রুত নষ্ট হওয়া ট্রান্সমিটার দুটি পুনঃস্থাপন করতে পারব বলে আশা করছি। এরপর ধীরে ধীরে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা হবে। তবে একসঙ্গে পুরো জেলায় বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করা সম্ভব হবে না। প্রথমে আমরা হাসপাতাল বিমানববন্দনসহ অতিগুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু করার চেষ্টা করব।’