যানজট নিয়ন্ত্রণের আশায় উড়াল সড়ক নির্মাণের পর রক্ষণাবেক্ষণ কে করবে, তা ঠিক হয়নি। জ্বলে না আলো, চুরি গেছে বিদ্যুতের তার। উপরের রাস্তার কার্পেটিং উঠে গর্ত হয়ে গেছে কোথাও কোথাও। পাশে ধুলা জমে উঁচু হয়ে আছে কোথাও কোথাও।
এই দুর্দশার কারণ, সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে ঠেলাঠেলি। কোনো একটি ফ্লাইওভার দুই সিটি করপোরেশনের এলাকায় পড়েছে। এখন দায়িত্ব নিতে চায় না কেউ।
কোথাও নির্মাতা প্রতিষ্ঠান সিটি করপোরেশনকে দায়িত্ব বুঝে নিতে চিঠি দিয়েছে, কিন্তু দায়িত্ব নিতে চাইছে না তারা।
সেই তুলনায় ভালো আছে বেসরকারি মালিকানাধীন মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার। যদিও সেখানেও নানা সময় নিরাপত্তাহীনতায় ছিনতাইয়ের ঘটনা আছে।
ঢাকায় ফ্লাইওভার আছে মোট পাঁচটি। এর মধ্যে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে দুটির অবস্থা ভালো নয়। এর একটি মগবাজার-মৌচাক, অন্যটি কুড়িল ফ্লাইওভার।
এই দুটির মধ্যে তুলনামূলক বাজে অবস্থায় কুড়িল ফ্লাইওভার। ২০১৩ সালের আগস্টে উদ্বোধনের পর উপরের সড়কের কার্পেটিং সংস্কার হয়নি খুব একটা। ফলে খিলক্ষেতে ওঠার রাস্তা, নিকুঞ্জে নামার রাস্তা, আর ৩০০ ফুট উড়াল সড়কে ওঠার রাস্তা খানাখন্দে ভরে গেছে।
সম্প্রতি কুড়িল এলাকায় সড়কও ভেঙেচুরে গিয়েছিল। সেখানে কোনো রকমে মেরামত করা হলেও উড়াল সড়কের উপরে কোনো মেরামত করা হয়নি। আর ঢালুতে ভাঙাচোরা থাকায় প্রতিদিন যানজট লেগে থাকে।
উপরের সড়কের ভাঙা অংশগুলো এতটাই বড় যে, একেবারে ধীরে চলা ছাড়া উপায় নেই। দ্রুতগতিতে চললে বড় বড় গর্তে চাকা পড়লে দুর্ঘটনার আশঙ্কা থাকে। একাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছেও।
নিকুঞ্জে উড়াল সড়ক থেকে নামার রাস্তায় খানাখন্দগুলো বেশি ঝুঁকি তৈরি করেছে। কারণ ঢালু পথ দিয়ে নামতে গেলে যানবাহনের গতি থাকে বেশি। বিশেষ করে মোটর সাইকেলের জন্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।
দুই পাশে ল্যাম্প পোস্ট থাকলেও জ্বলে না আলো। বাতিগুলোর বেশিরভাগ চুরি হয়ে গেছে। কিছু কিছু ভেঙে নিয়ে গেছে।
সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক করিম মিয়া বলেন, ‘ঝাঁকিতে অসুস্থ যাত্রীদের সমস্যা হয়। গাড়ির নাট খুইল্যা যায়। গাড়িতে নানান সমস্যা হয়।
‘রাতে লাইট না থাকার কারণে আন্ধারে সমস্যা হয়। বেরেক করলে পেছনের গাড়ি খেয়াল করে না, আইস্যা গাড়িতে ধাক্কা মারে। এইভাবে এক্সিডেন হয়।’
একই রুটে একটি বাসচালকের সহকারী মো. কবির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফেলাইওভারের পুরা রাস্তা ভাঙাচুরা। আমরা কেমতে চলুম, পাবলিক তো কথাই শুনে না। লাইট না থাকার কারণে ভাঙা যায়গা দিয়া গাড়ি চালাইতে মেলা কষ্ট অয়। ঝাঁকিতে পার্সপুর্স নষ্ট হয়া যায়।’
বাসযাত্রী হেলাল উদ্দিন জানান, ভাঙাচোরার কারণে বয়স্ক মানুষদের সমস্যা হয়। বেশি সমস্যা হয় অসুস্থ মানুষ ও মা-চাচিদের। ধুলাতেও নানা সমস্যা হয়। আর ফ্লাইওভারে লাইট থাকা জরুরি।
আরেক যাত্রী রফিকুল ইসলাম বলেন, রাতে ফ্লাইওভারে লাইট না থাকলে নানা ধরনের অনৈতিক কাজ হয়। অন্ধকারে চলে ছিনতাই। গাড়ির ওভারটেকিংয়ে সমস্যা হয়।
বাসচালক মোকাররম মিয়া বলেন, ‘মেইন প্রবলেম হইতাছে ভাঙাচুরার লাইগা ফেলাইওভারে উঠতে সমস্যা, নামতেও সমস্যা। ভাঙার কারণে গাড়ির পাত্তি ভাইঙা যায়, চাক্কা নষ্ট হয়া যায়। আমাগো গাড়িতে তো লাইট আছে, যাগো গাড়িতে লাইট নাই, তাগো সমস্যা হয় আন্ধারে।
‘ফেলাইওভারের ঢালে বিশ্ব রোডে উঠতে গেলে পুরাডাই ভাঙা। ভাঙায় গাড়ি চালাইতে গিয়া জ্যাম লাইগ্যা যায়। সার্জেন (সার্জেন্ট) না থাকার লাইগা হোন্ডা রং সাইড দিয়া যায়।’
উড়াল সড়কটি নির্মাণ করেছে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। তবে এখন তারা এর নিয়ন্ত্রণ ছেড়ে দিতে চায়।
রাজউকের সহযোগী প্রকল্প পরিচালক মনিরুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লাইওভার সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর প্রক্রিয়াধীন। আমরা তাদেরকে চিঠি দিয়েছি। খুব তাড়াতাড়ি আমাদের মিটিংয়ের মাধ্যমে হস্তান্তর করা হবে। যেহেতু হস্তান্তরের বিষয়টা এখনও প্রক্রিয়াধীন। তাই এই ফ্লাইওভার দেখভালে একটু সমস্যা হচ্ছে। তবে আমরা দ্রুত এই সমস্যার সমাধান করব।’
প্রায় একই পরিস্থিতি মগবাজার ফ্লাইওভারের। সেখানেও কোনো লাইট জ্বলে না। চুরি হয়ে গেছে বিদ্যুতের তার।
মোটরসাইকেল চালক সবুজ মিয়া বলেন, ‘ফ্লাইওভারের মাঝে ঢেউ ঢেউ; উঁচা-নিচা। রাস্তার মাঝের জয়েন্টগুলা ক্লিয়ার না। এই কারণে অনেক ঝাঁকি হয়। এই জয়েন্টগুলার কারণে গাড়ির স্পিড বেশি হলে এক্সিডেন্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। রানিং ফ্লাইওভার। তার পরে প্রচুর ধুলা।’
সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক লুৎফর মিয়া বলেন, ‘লাইট নাই, ট্রাফিক নাই। গাড়ি হুট কইরা ঢুইকা যায়। টেরাক উঠলে বালু দিয়া ভইরা যায়। ওই বালু আমাগো গাড়ির গ্যালাসে লাইগ্যা থাহে।
‘জলদি কইরা কোনো গাড়ি আইলে দ্যাখতে পারি না। অনেক আগে লাইট আছিল, অহন নাই ক্য কইতে পারি না।’
এই উড়াল সড়কটি নির্মাণ করেছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতর (এলজিইডি)। প্রতিষ্ঠানটির জনসংযোগ কর্মকর্তা হায়দার আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লাইওভার সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ বিষয়ে তারা ভালো বলতে পারবেন।’
তবে এখানে বেঁধেছে বিপত্তি। ঢাকা উত্তর সিট করপোরেশনের জনসংযোগ কর্মকর্তা এ এস এম মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারটি এখনও সিটি করপোরেশনের হাতে হস্তান্তর করা হয়নি। গত এক বছর যাবত হস্তান্তরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন।’
পরে এলজিইডি কর্মকর্তা হায়দার আলীকে আবার ফোন দিলে তিনি বলেন, ‘আমি ছয় মাস এখানে যোগদান করেছি। তাই আমি সঠিক জানি না। আপনি এলজিইডির তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আব্দুর রশীদের সাথে যোগাযোগ করেন।’
আব্দুর রশীদকে কয়েকবার কল করা হলেও তা রিসিভ হয়নি।