বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক দশক আগেই পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশকে আলাদা করতে পরিকল্পনা করা হয়। পাকিস্তান সরকার জেনেও গিয়েছিল সে উদ্যোগের কথা। করা হয় মামলা, গ্রেফতার করা হয় স্বাধীনতা অর্জনের চেষ্টায় জড়িতদেরকে।
অথচ স্বাধীন বাংলাদেশেই এই মামলাকে ‘মিথ্যা’ বলে প্রচার চালানো হয়েছে দিনের পর দিন।
আসামিদের একজন শওকত আলী। বর্ণাঢ্য সামরিক আর রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটিয়ে বাঙালির বীরদের একজন চলে গেলেন চিরকালের মতো। তবে ইতিহাসের অংশ হয়ে রয়ে যাবেন বাংলাদেশের অংশ হিসেবে।
সেটা ষাটের দশকের কথা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা তিনি। ছিলেন তরুণ ক্যাপ্টেন। বাঙালি অন্তপ্রাণ, বিদ্রোহী মন।
শেখ মুজিবুর রহমান তখনও বঙ্গবন্ধু হয়ে উঠেননি। তবে বাঙালির রাষ্ট্রগঠনের চিন্তা তখনই স্থান করে নেয় মনে। তার সঙ্গে যোগাযোগ হয় শওকত আলীর।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আগরতলা মামলার আসামিরা। ছবি: সংগ্রামের নোটবুক
পাকিস্তান তো আর বললেই স্বাধীনতা দিয়ে দেবে না। তাহলে লড়াইটা কীভাবে হবে? ভাবতে ভাবতে চেষ্টা করা হয় ভারতের সহযোগিতা নেয়ার।
শওকত আলী তার বই ‘সত্য মামলা আগরতলা’ বইয়ে লেখেন, “জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমরা যারা মামলাটিতে অভিযুক্ত ছিলাম, ‘ষড়যন্ত্র’ শব্দটি তাঁদের জন্য খুবই পীড়াদায়ক। কারণ আমরা ষড়যন্ত্রকারী ছিলাম না। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সশস্ত্র পন্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে আমরা বঙ্গবন্ধুর সম্মতি নিয়ে একটি বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম।”
কী ছিল পরিকল্পনা?
শওকত আলী লেখেন, ‘আমাদের পরিকল্পনা ছিল একটি নির্দিষ্ট রাতে এবং একটি নির্দিষ্ট সময়ে আমরা বাঙালিরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সব কটি ক্যান্টনমেন্টে কমান্ডো স্টাইলে হামলা চালিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানিদের অস্ত্র কেড়ে নেব, তাদের বন্দি করব এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করব।’
আগরতলা মামলা নিয়ে শওকত আলীর স্মৃতিচারণমূলক বই
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক গবেষক ও লেখক এ এস এম শামসুল আরেফিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘উনি (শওকত আলী) তো আর্মিতে ছিলেন, আর্মিতে থাকা অবস্থায় যখন ক্যাপ্টেন ছিলেন তখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাতে ওনার নাম আসে। আমরা তো এটাকে ষড়যন্ত্র মামলা বলি না। আমরা বলি আগরতলা মামলা। আর পাকিস্তান বলত ষড়যন্ত্র মামলা। এটাই বাস্তবতা ছিল। এটা বাঙলির জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পদক্ষেপ বলি।’
তিনি বলেন, ‘শওকত আলী সাহেব এটার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। সামরিক বাহিনী তখন খুব ভালোভাবে জড়িত ছিল। কিছু অফিসার আর তার মধ্যে তিনি একজন ছিলেন।
‘মামলা হলো বঙ্গবন্ধুসহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে। ওনারা এক সময় আটক ছিলেন। এরপর তো আন্দোলন করে বঙ্গবন্ধুসহ সবাইকে মুক্ত করা হয়।’
শামসুল আরেফীন বলেন, ‘এটা কখনো মিথ্যা মামলা ছিল না। আমাদের এই জেনারেশন জানে না বা তাদের কাছে সঠিক ইতিহাসের নথি জানানো হয়নি।
‘ষড়যন্ত্র মামলাতে ষড়যন্ত্র কার বিরুদ্ধে? পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তো? তাই না? তাইলে আমরা কেন এটাকে ষড়যন্ত্র বলব? এটা আগরতলা মামলা। আর এই মামলাতে ওনার ভূমিকা অনেক বেশি।’
জাতীয় সংসদ ভবনে মুক্তিযোদ্ধা শওকত আলীকে রাষ্ট্রীয় সম্মান। ছবি: পিয়াস বিশ্বাস
ভারত সরকারের সহায়তায় সশস্ত্র অভ্যুত্থানের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টায় লিপ্ত থাকার অভিযোগ এনে ১৯৬৮ সালের শুরুতে গ্রেফতার করা হয় বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে। এদের একজন ছিলেন শওকত আলী।
সে সময় ছয় দফা আন্দোলন করে নিজের অবস্থান করে নিয়েছেন শেখ মুজিবুর রহমান। আসামিদের গ্রেফতারে ফুঁসে উঠে বাঙালি। গড়ে তোলে প্রবল আন্দোলন।
এর মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে হত্যা করা হয় আসামিদের মধ্যে বাঙালি সার্জেন্ট জহুরুল হককে। আরও ফুঁসে উঠে বাঙালি। প্রবল আন্দোলনের মুখে ‘রাষ্ট্রদ্রোহীতা বনাম শেখ মুজিব ও অন্যান্য’ নামে মামলাটি। সেটি ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারির ঘটনা।
কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে শওকত আলীর মরদেহে বিভিন্ন সংগঠন ও ব্যক্তির শ্রদ্ধা
আগরতলা ষড়যন্ত্র সম্পর্কে ত্রিপুরার সে সময়ের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্রলাল সিংহ বলেন, ‘১৯৬৩ সালে আমার ভাই এমএলএ শ্রী উমেশলাল সিংহ সমভিব্যাহারে শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১০ জন ত্রিপুরার পালম জিলার খোয়াই মহকুমা দিয়ে আগরতলায় আমার আগরতলার বাংলোয় রাত ১২ টায় আগমন করেন।
‘প্রাথমিক আলাপ আলোচনার পর আমার বাংলো বাড়ি হইতে মাইল দেড়েক দূরে ভগ্নী হেমাঙ্গিনী দেবীল বাড়িতে শেখ সাহেব আসেন। সেখানেই খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তারপর শেখ সাহেবের প্রস্তাবনুযায়ী আমি আমাদর প্রধানমন্ত্রী পন্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরুর সাথে দেখা করি।
‘আমার সাথে ছিলেন শ্রী শ্রীরমণ, চিফ সেক্রেটারি। তাকে শ্রী ভাণ্ডরিয়ার বিদেশ সচিবের রুমে রেখে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করি। তিনি শেখ সাহেবকে ত্রিপুরায় থেকে প্রচার করতে রাজি হননি।
‘কারণ, চীনের লড়াইয়ের পর এতো বড় ঝুঁকি নিতে রাজি হননি। তাই ১৫ দিন থাকার পর তিনি (শেখ সাহেব) ত্রিপুরা ত্যাগ করেন। সোনামুড়া পশ্চিম ত্রিপুরারই এক মহকুমা কুমিল্লার সঙ্গে সংলগ্ন। শেখ মুজিবুর রহগমনাকে সর্বপ্রকার সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়।” (সূত্রঃ ‘আগরতলা মামলা, মেখ মুজিব ও বাংলার বিদ্রোহ’ লেখক জনাব ফয়েজ আহমেদ)
শওকত আলীর মৃত্যুতে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্বজনরা
এই ঘটনায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরি হারান শওকত আলী। সরাসরি যুক্ত হন রাজনীতিতে।
মামলা প্রত্যাহারের দুই বছর পরই শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। শওকত আল দেশের ডাক তখনও অগ্রাহ্য করেননি। যোগ দেন মুক্তিযুদ্ধে।
শুরুতে মাদারীপুর এলাকার কমান্ডার পরে ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টরের কমান্ডার ও প্রশিক্ষণ কর্মকর্তা ছিলেন। পরে মুজিবনগরে সশস্ত্রবাহিনীর সদর দপ্তরের স্টাফ অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন।
শামসুল আরেফিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মাদারীপুর এলাকায় উনি বেজ ক্যাম্প করে ওখানেই যুদ্ধ করেছিলেন। স্বাধীনের পরে উনি আর্মিতে ফিরে যান। আর্মিতে ফিরে উনি ফুল কর্নেল হিসেবে রিটায়ার্ড করেন।’
শওকত আলীর স্মৃতিচারণ করে এই গবেষক বলেন, ‘উনি অত্যন্ত সৎ ও সজ্জন মানুষ ছিলেন। এলাকার অনেক উন্নয়ন করেছেন। আমি ওনার এলাকায় গেছি। উনি যখন মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ করেন আমি তখন এটার সাথে যুক্ত ছিলাম।’
শওকত আলীকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষদের একাংশ
শওকত আলী মানুষের কাছে কতটা প্রিয় ছিলেন, তা নির্বাচনের ফলই বলে দেয়। তার এলাকা শরীয়তপুর-২ আসন থেকে যতবার ভোটে দাঁড়িয়েছেন, ততবার জিতেছেন। তার দল আওয়ামী লীগ সরকারে যাক আর বিরোধী দলে যাক, তিনি বরাবর জিতে আসেন বিপুল ভোটে। টানা ছয় বারের সংসদ সদস্য। একাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে এবার আর মনোনয়ন দেয়া হয়নি।
শওকত আলী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে নিয়ে গঠন করেন আলাদা সংগঠন। নাম ‘মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ’।
২০০৭-২০০৮ সালে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে আন্দোলন গড়ে উঠে, তাতেও অংশ নেন শওকত আলী।
শামসুল আরেফিন বলেন, ‘ওনাকে সঙ্গে নিয়ে আমরা প্রচুর আন্দোলন করেছি। এরশাদবিরোধী আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন। এরপর তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে বড় ভূমিকা রাখেন।’
শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য এ কে এম এনামুল হক শামীম শওকত আলীর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, ‘মহান মুক্তিযুদ্ধের তিনি অন্যতম সংগঠক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কর্নেল শওকত আলী সাহেবদের মতো দেশপ্রেমিক ছিলেন বলেই দেশ স্বাধীন করা অনেক সহজ হয়েছে।’
বিদায় বেলায় ফুলে ফুলে ছেয়ে যায় শওকত আলীর মরদেহবাহী অ্যাম্বুলেন্স
তিনি বলেন, ‘উনি যখন এমপি হন, আমি তখন ছাত্রলীগে। আমার সঙ্গে পরিচয় তখন থেকেই। উনি যখন এলাকাতে যেতেন আমি সঙ্গে থাকতাম। উনি খুব সৎ এবং সদালাপী মানুষ ছিলেন।’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যারা সোচ্চার ছিলেন উনি তাদের মধ্যে একজন। কখনই মাথা নত করেননি।’
‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের সৈনিক হিসেবে উনি সারাজীবন এই আদর্শ ধারণ করে গেছেন। কখনই মিথ্যার সঙ্গে আপস করেননি। বারবার মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছেন। কারগারে নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। সামরিক জান্তাদের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের লড়াইয়েও সামনের সারিতে ছিলেন।’