চট্টগ্রামকেন্দ্রীক ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের নতুন কমিটি ঘোষণার পর করণীয় নির্ধারণে বৈঠকে বসেছেন প্রয়াত আমির শাহ আহমদ শফীর অনুসারীরা।
রোববার সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম শহরের একটি এলাকায় এই বৈঠকে বসে বলে নিউজবাংলাকে জানিয়েছেন সদ্য বিলুপ্ত কমিটির যুগ্ম-মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী।
এর আগে দুপুরে হেফাজতের নতুন কমিটি ঘোষণা করা হয়, যার আমির করা হয় জুনাইদ বাবুনগরী আর মহাসচিব করা হয় নূর হোসাইন কাসেমীকে।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর আমির শাহ আহমদ শফীর মৃত্যু হয়। তার দুই দিন আগে তার হাটহাজারী মাদ্রাসায় ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। তখন শফী মাদ্রাসা প্রধানের দায়িত্ব ছাড়তে বাধ্য হন।
সেই ঘটনায় হেফাজতে বিভেদের বিষয়টি সামনে আসে। জাতীয় সম্মেলনের আগে তা প্রকাশ্যে আসে।
শফীর মৃত্যুর দুই মাস পর যে সম্মেলন আহ্বান করা হয় তাতে হেফাজতের প্রয়াত আমিরের ছেলে আনাস মাদানীসহ ৫০ জনের মতো আমন্ত্রণ পাননি। তারা এই সম্মেলনকে গঠনতন্ত্রবিরোধী দাবি করে সংবাদ সম্মেলনও করেন। তবে তাদের বক্তব্যকে পাত্তা না দিয়ে হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন করা হয়েছে।
সকালে জাতীয় সম্মেলন শেষে হাটহাজারী মাদ্রাসায় হেফাজতের নতুন কমিটি গঠন করা হয়
নতুন কমিটির আমির জুনাইদ বাবুনগরী বলেছেন, তাদের কমিটিই বৈধ। এর বাইরে কেউ কিছু করলে তারাই অবৈধ।
তবে বিদ্রোহীরা দমে না গিয়ে নিজেরাও আলাদা কমিটি ঘোষণার চেষ্টা করছেন।
মঈনুদ্দীন রুহী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সম্মেলনে যারা দাওয়াত পাননি তাদের নিয়ে জরুরি বৈঠক ডাকা হয়েছে। আমরা আলোচনা করে বৈঠকের সিদ্ধান্ত গণমাধ্যমকে জানিয়ে দেব।’
তবে কোথাও এই বৈঠক হচ্ছে, সেটা জানাতে রাজি হননি হেফাজতের এই বিদ্রোহী নেতা। জানান, নিরাপত্তাহীনতা এর কারণ।
আগের দিন সম্মেলন স্থগিত করার দাবি নিয়ে ডাকা সংবাদ সম্মেলনে হত্যার হুমকি পেয়ে আসেননি আনাস মাদানী।
নারী নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠন করা হয় হেফাজতে ইসলাম। তবে সংগঠনটি তুমুল আলোচিত হয়ে উঠে ২০১৩ সালে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে মাঠে নামে তারা।
ওই বছরের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার ঘটনায় ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। সেদিন রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নেতাকর্মীদের উচ্ছেদের পর হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে মরদেহ গুম করার অভিযোগ করে সংগঠনটি। তবে পরে এই অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। এমনকি হেফাজতের পক্ষ থেকে নিহত হিসেবে যাদের নাম দেয়া হয়েছিল তারা পরে ফিরে এসেছেন।
অরাজনৈতিক সংগঠন হলেও ওই ঘটনার পর থেকে হেফাজতের রাজনৈতিক গুরুত্বও তৈরি হয়।
পরে শাহ আহমদ শফী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। আর কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার পর সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় আহমদ শফীকে।
এর আগ পর্যন্ত হেফাজতের কমিটিতে যারা ছিলেন তারা বিএনপি-জামায়াত জোটের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ফলে হেফাজত রাজনৈতিক সংগঠন না হলেও তার নেতারা যে বিভিন্ন দলের সঙ্গে জড়িত, তারা সংগঠনকে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করতে পারতেন।
গত কয়েক বছরে কওমিপন্থী দলগুলোর মধ্যে নতুন বিভাজন তৈরি হয়েছে। একাংশ আওয়ামী লীগের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছেন। একাংশ আবার বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ।
আল্লামা শফী বেঁচে থাকতে আওয়ামী লীগের বলয়ে থাকা নেতারাই হেফাজতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিলেন। তবে ১৬ সেপ্টেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় যে হাঙ্গামা হয়, তার নেতৃত্বে বিএনপির সঙ্গে জড়িত নেতারা ছিলেন বলে ধারণা করা হয়।
সম্মেলনের আগে শফীপন্থীরা সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘কাউন্সিলের মাধ্যমে হুজুরের হাতে গড়া অরাজনৈতিক কওমি সংগঠনকে পরিকল্পিতভাবে জামায়াত-শিবির, বিএনপির হাতে তুলে দেয়ার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।’
ইসলামী ঐক্যজোটের মহাসচিব মুফতি ফয়জুল্লাহও একই দিন সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন, হেফাজতের একতরফা সম্মেলন মেনে নেয়া হবে না।
ইসলামী ঐক্যজোট বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয় ১৯৯৯ সালে। তবে মুফতি ফজলুল হক আমিনীর মৃত্যুর পর ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে তারা জোট ছাড়ে। এরপর আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রকাশ্যে সম্পর্ক না গড়লেও এক ধরনের সমঝোতা গড়ে তোলে তারা।
গত চার বছরে সরকারের কোনো সমালোচনা এই দলের নেতারা করেননি।