১০ বছরের আমিরের মৃত্যুর দুই মাস পর সংগঠনের নতুন নেতা নির্বাচনের আগে চাঙ্গা বিরোধ। কে আসছেন হেফাজতের নেতৃত্বে, এই প্রশ্নের চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে সংগঠন এক থাকতে পারবে কি না।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর শাহ আহমদ শফীর মৃত্যুর দুই দিন আগে হাটহাজারী মাদ্রাসায় বিক্ষোভ, বিক্ষোভের মধ্যে তার মাদ্রাসা প্রধানের পদ ছাড়া, এরপর মৃত্যুর ঘটনায় চাপা পড়া বিরোধ আবার চাঙ্গা হয়েছে।
হাটহাজারী মাদ্রাসায় বিক্ষোভের জেরে শাহ আহমদ শফী মাদ্রাসা প্রধানের পদ ছাড়েন। ছবি: সংগৃহীত
এর মধ্যে নতুন নেতা নির্বাচনে রোববার যে সম্মেলনের ডাক দেয়া হয়েছে, তাতে স্পষ্টতই নাখোশ হেফাজতের একাংশ।
সম্মেলনের আগের দিন প্রয়াত আমিরের শ্যালক মঈন উদ্দিন আর হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী বলেছেন, এই সম্মেলন স্থগিত করতে হবে।
সংবাদ সম্মেলনে আহমদ শফীর মৃত্যুকে পরিকল্পিত হত্যা বলে বিচারিক তদন্তের দাবিও জানানো হয়। বলা হয়, ‘হজরতের হত্যার বিচারের পূর্বে কোনো কাউন্সিল না করার জন্য হেফাজতে ইসলামের সকল দায়িত্বশীলদের কাছে অনুরোধ জানাচ্ছি।’
সম্মেলন করা হচ্ছে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর ডাকে।
হেফাজতের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী নিউজবাংলাকে বলেন, রোববার সকাল ১০টা থেকে চট্টগ্রামের দারুল উলুম হাটহাজারী মাদরাসায় সম্মেলন হবে। দেশের প্রায় ৩৫০ জন শীর্ষ মুরুব্বি ঠিক করবেন হেফাজতের নতুন নেতৃত্ব।
আমির পদে আলোচনায় যারা
নতুন আমির হিসেবে মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীর নামই সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে। নায়েবে আমির জুনায়েদ বাবুনগরীর মামা মুহিবুল্লাহ বাবুনগরীর নামও আলোচনায় রয়েছে।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী। ছবি: সংগৃহীত
ঢাকার জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল ও হেফাজতের ঢাকা মহানগর শাখার আমির নূর হোসাইন কাসেমীকে আমির করতেও তৎপর একটি পক্ষ।
তবে কাসেমি জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম নামে একটি রাজনৈতিক দলের নেতা। হেফাজত সবসময় নিজেকে অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দাবি করে থাকে। ফলে শীর্ষ নেতৃত্বে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব থাকলে এই পরিচয় বজায় রাখা যাবে কি না, এ নিয়েও কথা আছে সংগঠনে।
মহাসচিব পদে যাদের নাম আলোচনায়
আমিরের পাশাপাশি একই দিন সংগঠনটির মহাসচিবও নির্বাচন করা হবে। এই পদেও নূর হোসাইন কাসেমীর নাম আলোচনায় আছে।
নূর হোসাইন কাসেমী। ছবি: সংগৃহীত
এ ছাড়া চট্টগ্রামের জামিয়া উবাইদিয়া নানুপুর মাদ্রাসার পরিচালক মাওলানা সালাহউদ্দিন নানুপুরীর নামও উঠে আসছে।
সংগঠনটির নেতৃত্ব নির্বাচনে ২০১০ সালের মতোই চট্টগ্রামকেন্দ্রিকতা প্রাধান্য পাবে কি না, সেই প্রশ্নও আছে।
চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকার খিলগাঁও মাখজানুল উলুম মাদ্রাসার মাওলানা নুরুল ইসলাম জিহাদী, হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালনা কমিটির সদস্য মাওলানা শেখ আহমদ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার দারুল আহকাম মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা সাজিদুর রহমান এবং ঢাকার জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়ার সিনিয়র মুহাদ্দিস মাওলানা মামুনুল হকের নামও শোনা যাচ্ছে।
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ হাটাহাজরী উপজেলার সাধারণ সম্পাদক মাওলানা জাকারিয়া নোমান ফয়েজী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কওমিপন্থিদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা ও কোনো রাজনৈতিক অভিলাষ না থাকা এমন ব্যক্তিই হেফাজতের আমির-মহাসচিব পদে নির্বাচিত হবেন। বিতর্কিত কাউকে হেফাজত নেতা নির্বাচিত করবে না। বির্তকের ঊর্ধ্বে থাকবেন, এমন ব্যক্তিদের নির্বাচিত করা হবে যারা কওমি অঙ্গনের জন্য কাজ করে যাবেন।’
সম্মেলন অবৈধ দাবি এক পক্ষের
এদিকে হেফাজতের আসন্ন সম্মেলনকে অবৈধ দাবি করে প্রয়াত আমির আহমদ শফীর একদল অনুসারী শনিবার চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করেছেন।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে প্রয়াত আহমদ শফীর শ্যালক মঈন উদ্দিন বলেন, হেফাজতের ইসলামের বর্তমানে কোনো শুরা কমিটি নেই। শুরা কমিটি করতে ২০১৪ সালে প্রস্তাব করা হয়েছিল। তখন আল্লামা শফী বলেছিলেন, শুরা করলে সারা দেশের আলেমদের নিয়ে করতে হবে। কিন্তু এতে হাজারখানেক সদস্য হয়ে যাবে বলে পরে আর শুরা কমিটি করা হয়নি।
মঈন উদ্দিন বলেন, গঠনতন্ত্র অনুযায়ী আমিরের অবর্তমানে সিনিয়র নায়েবে আমির ভারপ্রাপ্ত হবেন। কেন্দ্রীয় কমিটি ও নির্বাহী কমিটির মতামতের ভিত্তিতে আমির নির্বাচন হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ও নির্বাহী কমিটির এখন পর্যন্ত কোনো সভা হয়নি। মহাসচিব জুনাইদ বাবুনগরী নিজেই কাউন্সিলের ডাক দিয়েছেন।
সংবাদ সম্মেলনে হেফাজতের যুগ্ম মহাসচিব মঈনুদ্দীন রুহী বলেন, সাত জন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে পাঁচ জন আমন্ত্রণ পাননি। ৩৫ জন নায়েবে আমিরের মধ্যে ২৩ জন এখনও দাওয়াত পাননি। তারা যেন আসতে না পারেন পরিকল্পিতভাবে সেই ব্যবস্থা করা হচ্ছে।
নারী নীতির বিরোধিতা করতে গিয়ে ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি গঠন করা হয় হেফাজতে ইসলাম। তবে সংগঠনটি তুমুল আলোচিত হয়ে উঠে ২০১৩ সালে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে গড়ে উঠা আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তাদের ধর্মদ্রোহী আখ্যা দিয়ে মাঠে নামে তারা।
ওই বছরের ৫ মে ১৩ দফা দাবিতে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অবস্থান নেয়ার ঘটনায় ব্যাপক হাঙ্গামা হয়। সেদিন রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নেতাকর্মীদের উচ্ছেদের পর হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করে মরদেহ গুম করার অভিযোগ করে সংগঠনটি। তবে পরে এই অভিযোগের প্রমাণ মেলেনি। এমনকি হেফাজতের পক্ষ থেকে নিহত হিসেবে যাদের নাম দেয়া হয়েছিল তারা পরে ফিরে এসেছেন।
২০১৩ সালের ৫ মে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশ করে হেফাজতে ইসলাম। ছবি: ফোকাস বাংলা
পরে শাহ আহমদ শফী সরকারের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। আর কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রি দাওরায়ে হাদিসকে ইসলামিক স্টাডিজে মাস্টার্সের সমমান দেয়ার পর সম্মিলিত কওমি মাদ্রাসা বোর্ডের চেয়ারম্যান করা হয় আহমদ শফীকে।