বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর জন্য প্রস্তুত এখন পর্যন্ত দেশের সবচেয়ে বড়, ৫০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ময়মনসিংহ সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র। কেন্দ্রটির পরীক্ষামূলক উৎপাদন (টেস্ট রান) প্রায় শেষ। আগামী সপ্তাহের কোনো এক সময় বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমতি পেতে যাচ্ছে কেন্দ্রটি।
তবে বাদ সেধেছে নদী রক্ষা কমিশন। ময়মনসিংহের গৌরীপুর উপজেলার সুতিয়াখালীতে এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির অবস্থান পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের ধারে।
নদী কমিশনের আপত্তি, কেন্দ্রটির ১৬০ একর জায়গার প্রায় ৬০ একরই পড়েছে নদীর জায়গায়। এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সেই জায়গা বেআইনিভাবে ব্যবহার করা হয়েছে।
জানতে চাইলে নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদার এই প্রতিবেদককে বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটির জায়গা নিয়ে কমিশনের আপত্তি আছে। কারণ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের তীরবর্তী (ফোর শোর) প্রায় ৬০ একর জায়গা এই কেন্দ্রটির কাজে ব্যবহার করা হয়েছে এবং নদের তীর বাঁধাই করা হয়েছ, যা বেআইনি। এই কাজের ফলে এবারের বন্যায় নদের অপর পারের একটি গ্রাম বিলীন প্রায় হয়ে গেছে।
সাবেক এ সচিব বলেন, দেশের বিদ্যমান আইন এবং সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্তৃপক্ষের স্পষ্ট নির্দেশনা আছে, কোনো উন্নয়নমূলক কাজে নদ-নদীর জায়গা ব্যবহার যাবে না। কিন্তু বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে সেই আইন ও নির্দেশনা লঙ্ঘন করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কমিশন গত মার্চ মাসে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছে।
জেলা প্রশাসনকে বলা হয়েছে যে, যদি ব্যবহৃত জায়গাটি লিজ দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে অবিলম্বে সেই লিজ বাতিল করে জায়গা উদ্ধার করা হোক। আর যদি অন্য কোনোভাবে জায়গাটি ব্যবহার করা হয়ে থাকে, তাহলেও তা উদ্ধার করার জন্য আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক।
বেঙ্গল টেন্যান্সি অ্যাক্টের ১৪৯ (৪) ধারা অনুযায়ী, প্রশাসন তা করতে পারে। কিন্তু তারা এখন পর্যন্ত কিছু করেছে বলে কমিশনের কাছে কোনো তথ্য আসেনি।
প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ার তিনটি কোম্পানির একটি যৌথ উদ্যোগ, যার নাম এইচডিএফসি। নদী কমিশনের এই আপত্তি সম্পর্কে জানতে চাইলে তারা দাবি করে, কেন্দ্রটি নির্মাণে ব্যবহৃত সম্পূর্ণ জায়গাই তাদের নিজস্ব মালিকানাধীন। কাজেই বিদ্যুৎকেন্দ্রের জায়গা নিয়ে এখন আর কারও আপত্তি করার সুযোগ নেই।
অন্যদিকে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলেছে, জায়গা নিয়ে আপত্তির বিষয় আগেই ফয়সালা হয়েছে। এখন কেন্দ্রটি বাণিজ্যিক উৎপাদনে যাওয়ার অপেক্ষায়।
বেসরকারি এই কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ কিনবে সরকার তথা বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। কেন্দ্রটির পরীক্ষামূলক উৎপাদনের পর্যায়ে পর্যবেক্ষণ করে বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমোদনও দেবে পিডিবি।
জানতে চাইলে পিডিবির আইপিপি সেল-১-এর পরিচালক (নির্বাহী প্রকৌশলী) আকেফুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘কেন্দ্রটি সফলভাবেই পরীক্ষামূলক উৎপাদন প্রায় শেষ করে এনেছে। দুই-চার দিনের মধ্যেই বাণিজ্যিক উৎপাদনের অনুমোদন দেয়া যাবে বলে আশা করছি।’
সৌর বিদ্যুৎ উৎপাদনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, এর জন্য বিপুল পরিমাণ খালি জায়গা দরকার হয়, যা বাংলাদেশে পাওয়া দুষ্কর। এ কারণে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য বড় বড় নদীর চরাঞ্চল ব্যবহারের। কিন্তু সেটা নদী রক্ষাসংক্রান্ত বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়। বড় আকারের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে এ এক উভয় সংকট।
গত এক দশকে বিদ্যুৎ খাতে সরকার প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করলেও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে খুব বেশি অগ্রগতি নেই। সরকারের নিজের পরিকল্পিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক পিছিয়ে আছে নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎ উৎপাদন।
নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা অনুযায়ী, ২০২০ সাল, অর্থাৎ চলতি বছরের মধ্যে দেশে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ২০২০ সাল শেষ হতে চললেও নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন আটকে আছে দুই-তিন শতাংশে। তাও আবার প্রায় ৫৫ বছর আগে স্থাপিত, দেশের একমাত্র কাপ্তাই জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উৎপাদন ক্ষমতাও হিসাবে ধরে।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) সর্বশেষ তথ্য হচ্ছে, দেশে এখন বিদ্যুতের সর্বমোট স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতা ২১ হাজার ৮৭৫ মেগাওয়াট। সে অনুযায়ী, সরকারের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য চলতি বছরের মধ্যে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা প্রায় ২ হাজার ১৮৮ মেগাওয়াট (১০ শতাংশ)।
সাসটেইনেবল অ্যান্ড রিনিউয়েবল এনার্জি ডেভেলপমেন্ট অথোরিটির (স্রেডা) ওয়েবসাইটের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে উৎপাদিত বিদ্যুতের স্থাপিত ক্ষমতা বর্তমানে ৭০০ মেগাওয়াটের কাছাকাছি, যা সর্বমোট স্থাপিত উৎপাদন ক্ষমতার ৩ শতাংশের কিছু বেশি।
নবায়নযোগ্য খাতের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতার অবস্থা স্থাপিত ক্ষমতার চেয়েও শোচনীয়।
পিডিবির তথ্য অনুযায়ী, এখন দেশে বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ১৫ হাজার মেগাওয়াট। সে অনুযায়ী নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হওয়ার কথা দেড় হাজার মেগাওয়াট (১০ শতাংশ)।
কিন্তু স্রেডার তথ্য হচ্ছে, দেশে এখন নবায়নযোগ্য উৎস থেকে বিদ্যুতের প্রকৃত উৎপাদন ক্ষমতা ৩১৭ মেগাওয়াটের কাছাকাছি, যা পরিকল্পনার মাত্র ২ শতাংশের কিছু বেশি।