বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

সিলেটেই কেন এত ট্রেন পড়ে

  • দেবাশীষ দেবু, সিলেট    
  • ১৩ নভেম্বর, ২০২০ ২০:৫২

গত বছরে এই রুটে অন্তত ২১ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। গত ১৬ আগস্ট থেকে ঘটেছে অন্তত পাঁচটি। সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলত ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন সেই গতি অর্ধেকে অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

বারবার দুর্ঘটনার কারণে সিলেট-আখাউড়া রেলপথ যাত্রীদের জন্য আতঙ্কের নাম হয়ে উঠেছে। গত ১৫ দিনে তিন বার দুর্ঘটনার কবলে পড়েছে ট্রেন।

সিলেট রেলের একজন প্রকৌশলী নিউজবাংলাকে বলেছেন, এই রুটের মতো এত দুর্ঘটনা তিনি তার চাকরি জীবনে কখনও দেখেননি।

এই রেলপথের দৈর্ঘ্য ১৭৯ কিলোমিটার। জরাজীর্ণ হয়ে পড়া এই সেকশনে রয়েছে ১৩টি ঝুঁকিপূর্ণ সেতু। রেলওয়ের ভাষায় যা ‘ডেডস্টপ’। লাইনও ত্রুটিপূর্ণ। এসবের সঙ্গে রয়েছে পুরনো ইঞ্জিন আর বগি। এইসব মিলিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে সিলেট-আখাউড়া রেলপথে ভ্রমণ।

করোনা সংক্রমণের কারণে চলতি বছরের ২৪ মার্চ থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত প্রায় পাঁচ মাস সিলেট-আখাাউড়া রুটে রেল চলাচল বন্ধ ছিল। ১৬ আগস্ট থেকে সীমিত আকারে ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত এই রুটে অন্তত পাঁচটি দুর্ঘটনা ঘটেছে।

গত বছরে এই রুটে অন্তত ২১ টি দুর্ঘটনা ঘটে। এরমধ্যে গত বছরের ২৩ জুন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় দুর্ঘটনায় পাঁচ যাত্রী মারা যান। আহত হন শতাধিক।

ঘনঘন দুর্ঘটনার কারণে এই সেকশনে ট্রেনের সময়সূচিও ঠিক থাকছে না। রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানান, সিলেট-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনে আগে ট্রেন চলত ৭০-৮০ কিলোমিটার গতিতে। এখন সেই গতি অর্ধেকে অর্থাৎ ৪০ কিলোমিটারে নেমে এসেছে।

ছয় বছর আগে রেলওয়ের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন আহসান হাবীব। বছর দেড়েক ধরে তিনি রেলওয়ের সিলেট স্টেশনে সহকারী নির্বাহী প্রকৌশলীর দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে তো প্রায় পাঁচ মাস ট্রেন চলাচল বন্ধ ছিল। এর আগে এক বছরে এই লাইনে যত দুর্ঘটনা হয়েছে আমার ছয় বছরের চাকরি জীবনেও এত দুর্ঘটনা দেখিনি।‘

আহসান হাবীব জানান, পাহাড়ি ও আঁকাবাকা সড়ক হওয়ায় আখাউড়া-সিলেট সেকশনের রশিপুর থেকে মাইজগাও পর্যন্ত সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তবে জরাজীর্ণ লাইন, মেয়াদোত্তীর্ণ সেতু ও পুরনো কোচের কারণে এই সেকশনে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে বলে জানান তিনি।

রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলীয় জোনের তথ্যমতে, আখাউড়া-সিলেট রেলপথে পারাবত, জয়ন্তিকা, পাহাড়িকা, উদয়ন, উপবন ও কালনি এক্সপ্রেসে প্রতিদিন ১২ থেকে ১৫ হাজার যাত্রী সিলেট-ঢাকা এবং সিলেট-চট্টগ্রাম যাতায়াত করেন।

সচতেন নাগরিক কমিটি সিলেটের সভাপতি ফরুক মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ট্রেনকে বলা হয় নিরাপদ বাহন। তবে ট্রেনের এই তকমা প্রশ্নের মুখে পড়েছে সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের কারণে। এই সেকশনে ঘনঘন দুর্ঘটনা ট্রেন যাত্রাকে করে তুলেছে অনিরাপদ। ট্রেনলাইন ও ট্রেনের বগি দ্রুত আধুনিকায়নের দাবি জানান তিনি।

ত্রুটিপূর্ণ রেলপথ, ঝুঁকিপূর্ণ সেতু

সিলেট-আখাউড়া রেল সেকশনের মোগলাবাজার থেকে মাইজগাও পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ জায়গায় স্লিপারের নাট-বল্টু খুলে গেছে। আবার কোথাও কোথাও নাট-বল্টু ঢিলে থাকায় রেল লাইন নড়বড়ে হয়ে আছে। রেলের দুই স্লিপারের মাঝখানে নেই পর্যাপ্ত পাথর।

এই সেকশনের সেতুগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। রেলওয়ের প্রকৌশল বিভাগের তথ্যমতে, নির্মাণের ৫০-৫৫ বছর পরই সেতুর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। অথচ এ রুটের ৯০ শতাংশ সেতুর বয়সই ৭০ বছর পেরিয়েছে। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ এরকম ১৩টি স্পটকে ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

এই রেলপথের একটি স্টেশনের সহকারী স্টেশন ম্যানেজার সজিব কুমার মালাকার বলেন, ডেডস্টপ হিসেবে চিহ্নিত করা সেতুর আগে ট্রেন থেমে যাবে, পরে ৫ কিলোমিটার গতিতে চলা শুরু করবে। সিলেট থেকে মোগলাবাজার স্টেশন পর্যন্ত ১৫ কিলোমিটারের মধ্যে ৮টি এবং মোগলাবাজার থেকে আখাউড়া পর্যন্ত ১৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে ৫টি সেতু ‘ডেড স্টপ’ হিসেবে চিহ্নিত বলে জানান তিনি।

রেলওয়ের প্রকৌশল শাখা জানায়, সিলেট-আখাউড়া সেকশনের অতিঝুঁকিপূর্ণ সেতুগুলোর মধ্যে রয়েছে- শমসেরনগর-টিলাগাঁও সেকশনের ২০০ নম্বর সেতু, মোগলাবাজার-মাইজগাঁও সেকশনের ৪৩, ৪৫ ও ৪৭ নম্বর সেতু, কুলাউড়া-বরমচাল সেকশনের ৫ ও ৭ নম্বর সেতু, সাতগাঁও-শ্রীমঙ্গল সেকশনের ১৪১ নম্বর সেতু, শ্রীমঙ্গল-ভানুগাছ সেকশনের ১৫৭ নম্বর সেতু, মাইজগাঁও-ভাটেরাবাজার সেকশনের ২৯নং সেতু এবং মনতলা-ইটাখোলা সেকশনের ৫৬ নম্বর সেতু। এ সেতুগুলো সংস্কারের কোনো প্রকল্প না থাকায় এখনই এগুলো সংস্কারের সম্ভাবনা নেই বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

ঘন ঘন দুর্ঘটনাগত বুধবার (১১ নভেম্বর) সিলেট ও মৌলভীবাজারের মধ্যবর্তী ভাটেরা নামক স্থানে মালবাহী ট্রেনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়ে পড়ে। এতে বন্ধ হয়ে যায় সিলেটের সঙ্গে সারাদেশের রেল যোগাযোগ।

এরআগে গত ৭ নভেম্বর মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলের সাতগাও জংশনে তেলবাহী ট্রেনের সাতটি বগি লাইনচ্যুত হয়। লাইনচ্যুত বগি ফুটো হয়ে গড়িয়ে পড়া তেল সংগ্রহে স্থানীয়দের হুড়োহুড়ির চিত্র দেশজুড়েই আলোচনার জন্ম দেয়। এ দুর্ঘটনায় সিলেটের সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ প্রায় ২৩ ঘণ্টা বন্ধ ছিল।

গত ৩০ অক্টোবর সিলেট রেল স্টেশনে দুই ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে ঘটনায় বেশ কয়েক ঘণ্টা ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকে। সেদিন ডক ইয়ার্ডে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়িকা এক্সপ্রেসের সামনের দিকে ধাক্কা দেয় জয়ন্তিকা এক্সপ্রেস।

১৫ সেপ্টেম্বর সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁও এলাকায় তেলবাহী ওয়াগনের একটি বগি লাইনচ্যুত হয়েছে। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রামের সাথে সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। ২৩ আগস্ট যাত্রীবাহি ট্রেন লাইনচ্যুত হয় কুলাউড়া এলাকায়। একই স্টেশনে গত ২৪ জানুয়ারি ট্রেনের বগিতে আগুন ধরে যায়। এভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়তই।

তবে সাম্প্রতিক সময়ে এই রুটে সবচেওেয় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে গত বছরের ২৩ জুন। এদিন মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার বরমচাল এলাকায় ঢাকাগামী উপবন এক্সপ্রেসের পাঁচটি বগি সেতু ভেঙে ছড়ায় পড়ে যায়। এতে পাঁচ জন নিহত ও শতাধিক যাত্রী আহত হন।

গত এক বছরে সিলেট-আখাউড়া রুটে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ঘটেছে তার তথ্য দিতে পারেননি সিলেটের স্টেশন মাস্টার জাহাঙ্গীর আলম। তবে বলেন, ‘এই রুটে ঘনঘন দুর্ঘটনা ঘটে।’

ডুয়েল গেজ দ্রুত বাস্তবায়নের দাবি: ঢাকা থেকে আখাউড়া পর্যন্ত রয়েছে ডুয়েল গেজ লাইন। কিন্তু আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত ব্রিটিশ আমলের রেল লাইনেই চলছে ট্রেন। গত বছরের এপ্রিলে সিলেট-আখাউড়া রেলপথকে ডুয়েল গেজে রূপান্তরিত করার জন্য একনেকে ১৬ হাজার ১৪৪ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন হয়। ২০২৫ সালের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার কথা।

তবে দ্রুত এই প্রকল্পের কাজ শেষ করার দাবি স্থানীয়দের। সিলেট-১ আসনের সাংসদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেনও এই দাবি জানিয়েছেন।

কুলাউড়ায় দুর্ঘটনার পর রেলমন্ত্রীকে দেওয়া এক ডিওলেটারে তিনি সিলেট-ঢাকা রুটে ব্রডগেজ বা ডুয়েলগেজ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব চালু করাসহ এই সেকশনে রেলওয়ের উন্নয়নে চার দফা প্রস্তাব দেন। তবে এখন পর্যন্ত শুরু হয়নি ডুয়েল গেজের কাজ।

এ ব্যাপারে সিলেট চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি আবু তাহের মো. শোয়েব বলেন, ‘সিলেটের সড়ক ও রেলপথ দুটোর অবস্থাই খুবই বাজে। সিলেট-আখাউড়া রেলপথকে ডুয়েল গেজ করা ও সিলেট-ঢাকা মহাসড়ককে ছয় লেনে উন্নীতের দাবি আমাদের দীর্ঘদিনের। কিন্তু চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হওয়ার পরও নানা জটিলাতায় দুটো কাজ শুরুতেই বিলম্ব হচ্ছে।

এ বিভাগের আরো খবর