রাজশাহী শহরের একমাত্র নারী পত্রিকা বিক্রেতা খুকির দায়িত্ব নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বুধবার প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে খুকির দায়িত্ব নিতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে রাজশাহী জেলা প্রশাসককে।
খুকির ওপর তৈরি একটি পুরনো ভিডিও সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। তারপর থেকে তার সংগ্রামী জীবনের গল্প নিয়ে দেশব্যাপী আলোচনা শুরু হয়। এরপরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এই নির্দেশনা আসে।
খুকির বাড়ি রাজশাহী নগরীর শিরোইল এলাকায়। তার পুরো নাম দিল আফরোজ খুকি। কিশোরী বয়সে ৭০ বছরের এক বৃদ্ধের সঙ্গে বিয়ে হয়েছিল তার। মাস না যেতেই স্বামী মারা যান। এরপরই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন।
১৯৮০ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর খুকি অসহায় হয়ে পড়েন। ভাইদের আপত্তিতে বাবার বাড়িতে তার জায়গা হয়নি। এরপর কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন তিনি। পাগলি মনে করে কেউ আশ্রয়ও দেয়না তাকে। পরে কারও দয়ার দিকে না তাকিয়ে খুকি বেছে নেন সংবাদপত্র বিক্রির পেশা।
এরপর থেকে রাজশাহী শহরে গত প্রায় ৪০ বছর ধরে পত্রিকা বিক্রি করছেন খুকি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বিভিন্ন সংবাদপত্র বুকে চেপে ধরে দোকানে দোকানে গিয়ে বিক্রি করেন তিনি।
প্রতিদিন ভোরে খুকি বাড়ি থেকে বের হয়ে হেঁটে নগরীর রেলওয়ে মার্কেটে পত্রিকার এজেন্টদের কাছ থেকে পত্রিকা কেনেন। তারপর সেখান থেকে হেঁটে হেঁটে রাজশাহীর রেলস্টেশন, শিরোইল বাস টার্মিনাল, সাগরপাড়া, আলুপট্টি, সাহেববাজার, আরডিএ মার্কেট ও নিউমার্কেটে পত্রিকা বিক্রি করেন। এসব স্থানে তার কিছু নিয়মিত ক্রেতা আছে। খুকি তাদের কাছে পত্রিকা বিক্রি করেন আবার সড়কে চলাচল করা বা বাজারে কেনাবেচা করতে আসা মানুষদের কাছে নিয়ে গিয়েও পত্রিকা কিনতে অনুরোধ করেন। তবে পত্রিকা বিক্রির বিনিময়ে তিনি কখনও অতিরিক্ত কোনো টাকা পয়সা নেন না।
নিজে কষ্ট করে চললেও তিনি তার উপার্জিত টাকায় কিছু অংশ দিয়ে সমাজসেবা করেন।
আগে খুকির প্রতিদিন আয় ছিল ৩০০ টাকা। করোনা মহামারির কারণে আয় কমেছে। খুকির প্রতিদিন আয় এখন ১৫০ টাকা। এই টাকা থেকে নিজের খরচ মাত্র ৫০ টাকা। কিছু টাকা নিজের কাছে রাখেন। বাকি টাকা গরিব মানুষকে দান করেন।
খুকির জীবনসংগ্রামের ওপর তৈরি ভিডিওটি ব্যাপক সাড়া ফেলেছে সেটা ২০০৯ সালে প্রচার করেছিল একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল। তখন সেটি নিয়ে তেমন এটা সাড়া পড়েনি। কিন্তু কয়েকদিন আগে হঠাৎ করেই খুকির সেই ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। এরপরই বিভিন্ন পর্যায় থেকে খোঁজ খবর নেয়া শুরু হয়। অনেকেই তার বাড়িতে যান।
বৃহস্পতিবার বিকেলে খুকির সঙ্গে কথা হয় তার বাড়িতে। তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, ‘পেপার বিক্রির কাজটা আমার ভালো লাগে। তাই আমি এটি করে যাচ্ছি। গত দুদিন ধরে অনেকেই খবর নিচ্ছে। টাকা দিয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছি। ঈদ ঈদ মনে হচ্ছে।’
খুকি আরও জানান, অসহায় অনেক নারীকে তিনি সেলাই মেশিন এবং তাদের স্বামীদের সাইকেল কিনে দিয়েছেন। এতিমখানা, মসজিদ এবং মন্দিরেও দান করছেন। বেশ কয়েকটি পরিবারকে স্বাবলম্বী হতে গবাদি পশু কিনে দিয়েছেন। এর সবই করেছেন সংবাদপত্র বিক্রির আয় আর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া নিজের সম্পত্তি থেকে। সমাজসেবা করতে গিয়ে নিজের বলতে কিছুই রাখেননি তিনি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে নির্দেশনা পাওয়ার পর জেলা প্রশাসক আব্দুল জলিল বুধবার খুকির বাড়ি গিয়ে তাকে সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। খুকির বাড়িটিও সংস্কার করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
আবদুল জলিল বলেন, ‘খুকি আমাদের দেশের সংগ্রামী নারীদের এক জ্বলন্ত উদাহরণ। আসলে অনেকে আমরা তাকে মানসিক প্রতিবন্ধী মনে করি। কিন্তু তিনি মানসিক প্রতিবন্ধী নন। তিনি কারোর কাছে হাত পাতেন না, কারোর কাছ থেকে ভিক্ষাও নেন না। তিনি নিজের আয়ে চলেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী কার্যালয় থেকে আমাকে বলা হয়েছে যে, খুকির দায়দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আমরা যেন গ্রহণ করি। খুকির আগামী দিনগুলো যেন সুন্দর হয় তাই তার দায়িত্ব নেয়ার কথা জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।’
আব্দুল জলিল বলেন, ‘আসলে তার যতটা না আর্থিক সহযোগিতা দরকার তার থেকে বেশি দরকার মানসিক সমর্থন। এ জন্য তার আত্মীয়স্বজনদের এগিয়ে আসা উচিত।’