কম নমুনা পরীক্ষার নীতি প্রয়োগের মাধ্যমে করোনা শনাক্তের সংখ্যা হ্রাস হওয়াকে বাংলাদেশে ‘করোনা নিয়ন্ত্রণ’ হিসেবে দাবি ও রাজনৈতিক অর্জন হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে।
এ কথা বলা হয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ- দ্বিতীয় পর্ব’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনে।
মঙ্গলবার এ উপলক্ষে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে আরো বলা হয়, করোনা মোকাবিলায় সরকারের কিছু কার্যক্রমে উন্নতি হলেও গৃহীত বিভিন্ন কার্যক্রমে এখনও সুশাসনের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। স্বাস্থ্যখাতের দুর্নীতি করোনা সংকটে প্রকটভাবে সামনে আসে। এই সংকটকে কেন্দ্র করে দুর্নীতির নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়েছে।
তথ্য প্রকাশে বিধিনিষেধ আরোপের মাধ্যমেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনাকে লুকানোর প্রবণতা দেখা গেছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
সংকট মোকাবিলায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণে ১৫ দফা সুপারিশ প্রদান করে সংস্থাটি।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. সুমাইয়া খায়ের, গবেষণা ও পলিসি বিভাগের সিনিয়র প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহজাদা এম আকরাম।
এ বছরের ১৬ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণের মাধ্যমে এই গবেষণাটি পরিচালিত হয়েছে।
গবেষণায় দেখা যায়, করোনা মোকাবিলায় প্রাসঙ্গিক যেসব আইন রয়েছে, তার মধ্যে করোনা মোকাবিলায় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা আইন, ২০১২ ও সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮-এর কোনোটিই যথাযথভাবে এখনও অনুসরণ করা হচ্ছে না।
করোনা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত প্রকল্পের ক্রয়সহ সকল ক্রয়ে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা ২০০৮ অনুসরণ করা হয়নি।
গবেষণায় আরও দেখা যায়, পাশের দেশ ভারতসহ অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্তে পরীক্ষাগার ও নমুনা পরীক্ষায় ঘাটতি রয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী একটি দেশে শনাক্তের হার মোট নমুনা পরীক্ষার ৫ শতাংশের বেশি হলে উক্ত দেশে প্রয়োজনের তুলনায় অপর্যাপ্ত পরীক্ষা করা হচ্ছে বলে নির্দেশ করে।
কিন্তু বাংলাদেশে ১৬ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গড় শনাক্তের হার ছিল ১৭ দশমিক ৪ শতাংশ, সর্বোচ্চ ছিল ৩১ দশমিক ৯ শতাংশ।
১৫ জুনপরবর্তী সময়ে কারিগরি পরামর্শক কমিটিসহ বিশেষজ্ঞরা প্রতি দিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন। অথচ পরীক্ষাগারের সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও ১৫ জুন থেকে ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত গড়ে প্রতিদিন ১৩ হাজার করে পরীক্ষা করা হয়েছে। আক্রান্তের দিক থেকে বাংলাদেশ বিশ্বে ২০তম অবস্থানে থাকলেও জনসংখ্যার অনুপাতে পরীক্ষার হারের দিক থেকে বাংলাদেশ অবস্থান বিশ্বে ১৬২তম। নমুনা পরীক্ষার বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে বাংলাদেশ এখনও অনেক পিছিয়ে।
করোনা সংক্রমণের সঠিক চিত্র পেতে ও দ্রুততার সাথে আক্রান্ত ব্যক্তি চিহ্নিত করতে গত ৩ জুন কারিগরি পরামর্শ কমিটি আরটি-পিসিআর পরীক্ষার পাশাপাশি অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন পরীক্ষার সুপারিশ করলেও এখনও তা কার্যকর হয়নি।
গবেষণায় নমুনা পরীক্ষায়ও দুর্নীতির চিত্র উঠে এসেছে। যাচাই না করার ফলে লাইসেন্সবিহীন হাসপাতাল ও প্রতিষ্ঠানের সাথে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর করোনা পরীক্ষা করার চুক্তি সম্পাদন করেছে। এমন একটি প্রতিষ্ঠান দেশের বিভিন্ন এলাকার থেকে নমুনা সংগ্রহ করে কোনো পরীক্ষা না করেই ১৫ হাজার ৪৬০ জনকে করোনা পরীক্ষার ভুয়া রিপোর্ট দেয়। এভাবে এই প্রতিষ্ঠান সাত কোটি ৭০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
সংবাদ সম্মেলনে ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘করোনা ভাইরাস সংকট মোকাবিলায় জাতীয় এবং স্থানীয় উভয় পর্যায়েই সুশাসনের সবগুলো নির্দেশকেই ব্যত্যয় ঘটেছে ও ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। করোনা ভাইরাসের এই সংকট মোকাবিলার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যখাত যে চাপের মধ্যে পড়েছে, এর সুযোগ নিয়ে দুর্নীতিবাজ, দুর্নীতির সুবিধাভোগী ও দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ব্যক্তিরা দুর্নীতির মহোৎসবে নেমেছে।’