বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আট দিনে নামজারি কতটা সম্ভব

  • আপেল মাহমুদ, কন্ট্রিবিউটর রিপোর্টার   
  • ১০ নভেম্বর, ২০২০ ১৭:৫১

ভূমি নিবন্ধনের নিয়মকানুন ও প্রক্রিয়া সহজ করার যেসব উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা বাস্তবায়ন করতে বেগ পেতে হবে। সবচেয়ে বড় সমস্যা দেখা দেবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোনো জনবল কাঠামোই নেই ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়গুলোয়।

জমি কেনা ও নিবন্ধন সহজ করতে যে একগাদা পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে সরকার, তার মধ্যে সবচেয়ে চমকপ্রদ উদ্যোগটি হলো, এখন থেকে আট দিনে জমির নামজারি সম্পন্ন হবে। সোমবার এ প্রস্তাবে অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা।

প্রস্তাবে বলা হয়, জমি নিবন্ধনের সর্বোচ্চ আট দিনের মধ্যে নামজারি করতে এসি ল্যান্ড (সহকারী কমিশনার ভূমি) সফটওয়্যারের মাধ্যমে সাব-রেজিস্ট্রি অফিস থেকে প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত জেনে নেবেন। একইভাবে দলিল নিবন্ধের আগে সাব-রেজিস্ট্রাররা তথ্য জানবেন এসি ল্যান্ড অফিস থেকে।

সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, ১৭টি উপজেলায় পাইলট ভিত্তিতে এ কাজ চলছে। পর্যায়ক্রমে এক বছরের মধ্যে সারা দেশেই তা বাস্তবায়ন হয়ে যাবে। এর মাধ্যমে জমি সংক্রান্ত মামলা মোকদ্দমা, দুর্নীতি ও অনিয়ম কমে যাবে।

সরকারের এ সিদ্ধান্ত যুগান্তকারী সন্দেহ নেই। কিন্তু এক বছরের মধ্যে এটি সারা দেশে চালু করার মতো বাস্তব অবস্থা বা সামর্থ্য কি আছে? পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করলে মনে হতে পারে, সরকারের এ পদক্ষেপ উচ্চাভিলাসী। কারণ, এটি বাস্তবায়ন করতে হলে তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো প্রয়োজন হবে।  

যে এসি ল্যান্ড ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের মাধ্যমে এ যুগান্তরকারী পদক্ষেপটি বাস্তবায়িত হওয়ার কথা, সেসব অফিসে কম্পিউটার অপারেটরের পদই নেই। ফলে প্রশিক্ষিত লোকবল ছাড়া উমেদার (বহিরাগত লোক) দিয়ে কম্পিউটারের কাজ চালাতে হচ্ছে। তাদের পারিশ্রমিক এসি ল্যান্ড কিংবা সাব-রেজিস্ট্রারদের পকেট থেকে মেটাতে হচ্ছে। এমনকি কম্পিউটারের সরঞ্জাম, কাগজ, কালি ছাড়াও এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ করার জন্য কোনো সরকারি বরাদ্দ নেই।

ঢাকা এবং তার আশপাশের কয়েকটি এসি ল্যান্ড ও সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ স্থানে উমেদার দিয়ে কম্পিউটারের কাজ করানো হচ্ছে। এসি ল্যান্ড অফিসে কম্পিউটার কাম অফিস সহায়ক নামে একটি পদ থাকলেও সেখানে কোনো লোকবল নেই। কোথাও কোথাও লোকবল থাকলেও তাকে বিভিন্ন অফিসিয়াল রেজিস্ট্রার, চিঠিপত্র লেখা ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। অপর দিকে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে এ ধরনের কোনো পদই নেই।

রাজধানীর ক্যান্টমেন্ট এসি ল্যান্ড অফিসে গিয়ে দেখা গেছে, চারজন উমেদার (নাম- বিল্লাল, রানা, শাহজাদা, হানিফ) কম্পিউটার নিয়ে বসে আছেন। অনলাইনে নামজারি ফরম পূরণের কাজ করছেন।

একজন উমেদার বললেন,‘নামজারি এবং অন্যান্য সেবা প্রার্থীদের আর্থিক সহযোগিতায় পেট চলছে। এটা ঘুষ বলতে পারেন, আবার বকশিসও বলতে পারেন।’

সরকারি বরাদ্দ না থাকায় এভাবে জোড়াতালি দিয়ে এসি ল্যান্ড অফিসের কম্পিউটার কার্যক্রম চলছে। নগরীর গুলশান ও তেজগাঁওয়ের গুরুত্বপূর্ণ এসি ল্যান্ড অফিসেও একই চিত্র দেখা গেছে।

এসব উমেদারদের পারিশ্রমিক কিভাবে জোগাড় হয় জানতে চাইলে এসি ল্যান্ড অফিসের কানুনগো আবদুল হান্নান সদুত্তর দিতে পারেননি। বললেন, ‘অফিস থেকে ম্যানেজ করে ওদেরকে বেতন দেয়া হয়। এর জন্য সরকারি কোন সহযোগিতা পাওয়া যায় না।’  

নামজারির ক্ষেত্রে এসি ল্যান্ড অফিসের সহযোগী দপ্তর হিসেবে কাজ করে দেশের তহশিল অফিসগুলো। দলিল পর্চা ও দখল যাচাই বাছাই করে তহশিলদার (সহকারি ভূমিকর্তা) প্রতিবেদন দেয়ার পরই তা এসি ল্যান্ড মঞ্জুর বা নামঞ্জুর করেন।

এ বিষয়ে ইব্রাহিমপুর তহশিল অফিসে কর্মরত সহকারি ভূমি কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন ‘কাগজপত্র ঠিক থাকার পরেও নামজারির ক্ষেত্রে জমির দখল একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সেটা সহকারি ভূমি কর্মকর্তা বা উপ-সহকারি ভূমি কর্মকর্তারা সরেজমিন তদন্ত করে নিশ্চিত করেন। তাছাড়া পর্চায় ছবি থাকে না বলে অনেকে নকল মালিক সেজে জমির নামজারি করে অন্যত্র বিক্রি কিংবা ব্যাংক থেকে মোটা অংকের ঋণ তুলে নেয়। জমির সঠিক মালিকের বিষয়টিও তহশিল অফিসগুলো নির্ণয় করে থাকে।’

ঢাকা রেজিস্ট্রেশন কমপ্লেক্সের ১০টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস ঘুরে দেখা গেছে, এর কোনোটাতেই কম্পিউটার অপারেটরের পদ নেই। উমেদার কিংবা এক্সট্রা মোহরার ও মোহরার দিয়ে কম্পিউটারের কাজ করানো হচ্ছে। যেহেতু পদ নেই, যার কারণে কম্পিউটার কেনা, রক্ষণাবেক্ষণ বা কালি কাগজ কিনতে হয় নিজেদের পকেট থেকে।

বাংলাদেশ রেজিস্ট্রেশন সার্ভিস এসোসিয়েশন (বিআরএসএ) মহাসচিব জাহিদ হোসেন বলেন, ‘নিবন্ধন অধিদপ্তরের আওতাধীন সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের কর্মকর্তা কর্মচারির তালিকায় কম্পিউটার অপারেটর নামে কোনো পদ নেই। এ কারণে এ ক্ষেত্রে লোকজন ও আর্থিক বরাদ্দ থাকার কোনো প্রশ্ন ওঠে না। একজন সাব-রেজিস্ট্রার, একজন কেরানি (অফিস সহকারী), একজন টিসি মোহরার, দুইজন মোহরার এবং কিছু এক্সটা মোহরার নিয়ে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের লোকবল কাঠামো।’

বিআরএসএ-এর একটি সূত্র জানায়, বর্তমানে দেশের রেজিস্ট্রি অফিসে যে জনবল রয়েছে, তা দিয়ে অনলাইনে দলিল রেজিস্ট্রি করা সম্ভব নয়। কারণ অফিসে আইটি সেকশন তথা কম্পিউটার অপারেটরের পদই নেই। এজন্য আইন মন্ত্রণালয় ১৭টি সাব-রেজিস্ট্রি অফিস নিয়ে একটি পাইলট প্রকল্প করে এর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ করছে। এ লক্ষ্যে ১৯৫০ সালের প্রজাস্বত্ব আইনের কিছু ধারা পরিবর্তন, পরিমার্জন, সংশোধন করার চিন্তা ভাবনাও করা হচ্ছে। 

ঢাকা জেলা রেজিস্ট্রার সাবিকুন নাহার বলেন,‘দলিল নিবন্ধন ও নামজারির ক্ষেত্রে সফটওয়্যার ব্যবহার একটি যুগান্তরকারী পদক্ষেপ। তবে তা চালু করার আগে কম্পিউটারে প্রশিক্ষিত লোকবল প্রয়োজন। সে জন্য পদ সৃষ্টি করে পর্যাপ্ত লোক নিয়োগ দিতে হবে। তা না হলে হয়রানি বাড়বে। কাজের গতি ধীর হয়ে গেলে রেজিস্ট্রি অফিসে আসা সেবাপ্রার্থিরা নানা ভোগান্তির শিকার হবেন।’

একাধিক সাব-রেজিস্ট্রার ও এসি ল্যান্ড নাম প্রকাশ না করে বলেন, প্রশিক্ষিত পর্যাপ্ত লোকবল না থাকলে নামজারি কিংবা জমি নিবন্ধন দীর্ঘসূত্রতায় পড়বে। এতে কাগজপত্র যাচাই করে তাৎক্ষণিকভাবে দলিল নিবন্ধন হবে না। দাখিল করা দলিল যাচাই করতেই তিন দিন লেগে যাবে।

অন্যদিকে নামজারির কাগজপত্র যাচাই বাছাই করতেও অনেক সময় লেগে যাবে। এ ক্ষেত্রে জমির দখল দেখা কিংবা সঠিক ব্যক্তি নির্ণয় করা কঠিন হবে। এর জন্য অবশ্যই ভূমি ও রেজিস্ট্রেশন আইনের কিছু ধারার পরিবর্তন ও সংযোজনের দরকার পড়বে।

কাজ এক, মন্ত্রণালয় তিন

অনুসন্ধানে দেখা যায়, স্বচ্ছভাবে নামজারি এবং দলিল নিবন্ধন করার ক্ষেত্রে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) বা পাসপোর্ট গ্রহণযোগ্য সনাক্তকরণ নথি হিসাবে কাজ করছে। কিন্তু এসি ল্যান্ড বা সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে তা যাচাইয়ের কোনো সুযোগ নেই।

একইভাবে কোনো এসি ল্যান্ড দলিল এবং সাব-রেজিস্ট্রার আরওআর কিংবা নামজারি খাজনার কাগজপত্র তাক্ষণিক যাচাই বাছাই করতে পারেন না। এজন্য তাদেরকে ম্যানুয়েল ও সময়সাপেক্ষে পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। এ সুযোগে অনেক ভুয়া মালিক জমির নিবন্ধন ও নামজারি করার সুযোগ পাচ্ছে।

ভূমি সংস্কার নিয়ে দীর্ঘ দিন কাজ করা ভূমি বিশেষজ্ঞ শামসুল হুদা বলেন, ‘জমি রেজিস্ট্রেশন হয় আইন মন্ত্রণালয়ে। আবার এর নামজারি হয় ভূমি মন্ত্রণালয়ে। নামজারির দায়িত্বে থাকা মাঠ পর্যায়ে কর্মরত মূল কর্মকর্তা এসি ল্যান্ডদের নিয়ন্ত্রণকারি মন্ত্রণালয় হলো জনপ্রশাসন। ফলে সমন্বয়হীনতা আর জবাবদিহির জটিলতা সৃষ্টি হচ্ছে। এসব সমস্যা সবার আগে দূর করতে হবে।’

তিনি মনে করেন, দ্রুত দলিল নিবন্ধন আর নামজারি যাই করা হোক না কেন, ভূমি প্রশাসনটি সবার আগে একই ছাতার নিচে আনতে হবে। দীর্ঘদিনের দাবি ছিল, দেশে ‘ল্যান্ড ক্যাডার’ ও ‘ল্যান্ড কমিশন’ গঠন করা। তা বাস্তাবায়ন হলে দ্রুত কাজ ও করা যাবে। আবার কর্মকর্তা কর্মচারিদের মধ্যে জবাবদিহিও আসবে। দুঃখজনক হলেও সত্যি, দেশে মৎস্য কিংবা পোস্টাল ক্যাডার থাকলেও গুরুত্বপূর্ণ বড় সেক্টর হওয়ার পরও দেশে ‘ল্যান্ড ক্যাডার’ সৃষ্টির কোনো উদ্যোগ নেই।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক এসি ল্যান্ড বলেন, সরকারি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা এসি ল্যান্ডদের দায়িত্ব। কিন্তু অফিস ডিজিটালাইজড করতে হলে যে আইটি সাপোর্ট দরকার তার কোনোটাই নেই। লোকবল তো নেইই। এমনকি ইন্টারনেট বিলটা পর্যন্ত কর্মকর্তাদের নিজেদের পকেট থেকে দিতে হয়। ধীরগতির ইন্টারনেটের কারণে কাজে নানা ঝামেলা হয়। আগে ম্যানুয়েলি নামজারির দরখাস্ত গ্রহণ করতে সর্বোচ্চ পাঁচ মিনিট লাগলেও এখন অনলাইনে তা শেষ করতে পাঁচ ঘণ্টা লেগে যায়।

এ বিভাগের আরো খবর