সিলেটের কানাইঘাট সীমান্তে ধরা পড়া বরখাস্ত এসআই আকবর হোসেন ভুঁইয়ার দুটি ভিডিও ফেসবুকে প্রকাশ হয়েছে। একটিতে দেখা যায়, কয়েকজন যুবক ঘিরে ধরে বারবার তাকে জেরা করছেন। আর আকবর বলছেন, তিনি খুন করেননি।
গত ১১ অক্টোবর সিলেটের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে হত্যার অভিযোগ ওঠার প্রায় এক মাস পর প্রধান আসামি আকবর ধরা পড়েন।
আকবরদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ফাঁড়িতে এক জনকে আটক করে ১০ হাজার টাকা না পেয়ে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।
ফেসবুকে প্রকাশিত ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি পাহাড়ি ছড়ায় পাথরের উপর আকবর হোসেনকে বসিয়ে রেখে হাত-পা বাঁধছেন কয়েকজন যুবক।
এ সময় চারপাশ ঘিরে রাখেন স্থানীয় কিছু মানুষ। তার পায়ে রশি বাঁধা ছিল। সেই বাঁধন খুলে আকবরের বাহু বাঁধছিলেন যুবকরা।
তখন আকবর হোসেন হাতজোড় করে কাঁদছিলেন। না বাঁধার জন্য অনুরোধও করছিলেন।
সবাই আকবরকে চিনতে পারেননি। তারা বারবার জিজ্ঞেস করছিলেন তার পরিচয়।
- আরও পড়ুন: ভারতে পালাতে গিয়ে ধরা এসআই আকবর
একজন বলেন, ‘নাম কিতা, ওই নাম কী তোমার?’
‘আলী আকবর’- জবাব দেন রায়হান হত্যা মামলার প্রধান আসামি।
পাশের একজন বলেন, ‘এটা পুলিশ। রায়হানরে মারছে।’
তখন একজন জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি মারবার অধিকার পাইলা কই?’
আকবর বলেন, ‘আমি সাথে সাথে হাসপাতালে পাঠাইছি।’
আরেকজন বলেন, ‘১০ হাজারের লাগি তোরা মানুষ মারস রে।’
এ সময় হাতজোর করে আকবর বলেন, ‘আমি মারি নাই ভাই, আমি মারি নাই।’
‘আমি বাঁচব না’-বলেও আকুতি মিনতি করছিলেন আকবর।
তবে ধরলেও আকবরের সঙ্গে তারা দুর্ব্যবহার করেননি। বরং বোতলে ভরে পানি পান করতে দিয়েছেন।
আড়াই মিনিটের ভিডিওর শেষ দিকে আকবরের হাত-পা বেঁধে পাহাড়ি ছড়া দিয়ে তাকে হাঁটিয়ে নিয়ে আসতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় ভিডিও
কিছুক্ষণ পর ফেসবুকে আরও একটি ভিডিও প্রকাশ হয়। সেখানে দেখা যায়, দাঁড় করিয়ে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে আকবরকে।
তিনি বলেন, ‘আমি খুনি না, আমি ইচ্ছা করে আমি একা মারিনি। ইচ্ছা করে একা মারিনি। মাইর দিছিল পাঁচ ছয় জন। এ জন্য মরে গেছে ভাই।’
কে?-জিজ্ঞেস করেন একজন
আকবর জবাব দেন, ‘একটা ছেলে।’
বয়স কত হয়েছে ছেলের- প্রশ্ন।
‘৩২ হবে’-বলেন আকবর।
সে কিতা করছে- প্রশ্ন।
আকবর বলেন, ‘ছিনতাই করছিল, ছিনতাই।’
কিসের ছিনতাই করছিল-প্রশ্ন
আকবর বলেন, ‘টাকা ছিনতাই করছিল।’
তোরা জান ছিনিয়ে নিছিস- এসআই আকবরকে বলেন একজন।
আকবর বলেন, ‘আমরা জান নেই নাই। আমরা হাসপাতালে নিয়েছি। পাবলিক মারছিল, আমরা হাসপাতালে নিয়েছি। কিন্তু ওখান থেকে মরে গেছে।’
তুমি হাসপাতাল নিয়া গেছ। তাইলে কিতার লাগি তুমি ভাগছে- প্রশ্ন।
আকবর বলেন, ‘আমি ভাগছি যে সাসপেন্ট (বরখাস্ত) করছে, অ্যারেস্ট করতে পারে। বলেছে যে, দুই মাস পর ঠান্ডা হয়ে যাবে, দুই মাস পর ঠান্ডা হয়ে গেলে আবার গেলে এটা হ্যান্ডেল করা যাবে। আমি অন্য কোনো কারণে ভাগি নাই।’
‘আমরা জান নেই নাই।’
এর লাগি তো ভাগছ- আবার মন্তব্য করেন একজন।
আকবর বলেন, ‘আমার সিনিয়র অফিসার বলছিল, আপাতত চলি যাও, কয়দিন পরে আইস। দুই মাস পরে মোটামুটি একটু ঠান্ডা হয়ে যাবে।
ইন্ডিয়া কেমনে আসছ- প্রশ্ন।
আকবর বলেন, ‘ইন্ডিয়া একটা পরিবার আছে। বলছিল, যে গেলে এখানে থাকার জায়গা পাবে। মাঝের গাঁও এখানে, ভোলাগঞ্জ। ’
পুলিশ যা বলছে
কানাইঘাটের স্থানীয় কয়েকজন জানান, ভিডিওর যুবকদের কথাবার্তা ও এলাকা দেখে বোঝা গেছে, তারা ভারতের খাসিয়া আদিবাসী হতে পারেন।
যদিও সিলেটের এএসপি আব্দুল করিম জানিয়েছেন, ভারতে পালানোর সময় কানাইঘাটের লক্ষ্মীপ্রসাদ সীমান্ত এলাকা থেকে আকবরকে গ্রেফতার করা হয়। বিকেল পাঁচটায় তাকে নিয়ে সিলেটের পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করা হবে।
গত ১০ অক্টোবর শনিবার মধ্যরাতে রায়হানকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়ি পুলিশ। পরদিন ১১ অক্টোবর ভোরে ওসমানী হাসপাতালে তিনি মারা যান।
রায়হানের পরিবারের অভিযোগ, ফাঁড়িতে ধরে এনে তার কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা চেয়েছিল পুলিশ। না দেয়ায় রাতভর নির্যাতন করা হয়। এ কারণে মারা যান তিনি।
ওই রাতেই রায়হানের স্ত্রী তাহমিনা আক্তার নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইনে মামলা করেন।
সিলেট মহানগর পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মো. আজবাহার আলী শেখের তত্ত্বাবধানে মহানগর পুলিশের তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান কমিটি তদন্ত করে ফাঁড়িতে পুলিশ হেফাজতে মৃত্যুর বিষয়ে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়।
১২ অক্টোবর ফাঁড়ির ইনচার্জ আকবর হোসেন ভূঁইয়াসহ চার জনকে সাময়িক বরখাস্ত ও তিন জনকে ফাঁড়ি থেকে প্রত্যাহার করা হয়।
এরপর থেকে আকবর পলাতক ছিলেন। তাকে পালানোতে সহায়তা ও তথ্য গোপনের অভিযোগে ২১ অক্টোবর ফাঁড়ির আরেক এসআই হাসানকেও সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।
গত ১৩ অক্টোবর মামলাটি পিবিআইতে হস্তান্তর করা হয়। ১৫ অক্টোবর রায়হানের মরদেহ কবর থেকে তুলে দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্ত করা হয়। তখন জানা যায়, ভোঁতা অস্ত্রের আঘাতেই রায়হানের মৃত্যু হয়।
আকবরের আগে এই মামলায় গ্রেফতার হয়েছেন কনস্টেবল টিটু চন্দ্র দাস ও হারুন উর রশিদকে, সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) আশেক এলাহী ও ছিনতাইয়ের অভিযোগ তোলা সাইদুর শেখ।
এই মামলায় দুই দফায় রিমান্ডে গেলেও পুলিশ সদস্যরা কেউ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি হননি।