ঢাকার কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট এলাকার বালুঘাট নামাপাড়া বস্তি। পাশে সুউচ্চ আবাসিক ভবন। দুটির তুলনা হয় না কোনো দিক থেকে।
একটিতে মানসম্পন্ন আবাসন, অন্যটিকে কোনো রকমে টিকে থাকা। কিন্তু ভাড়া বিবেচনা করলে চমকে যাওয়ার মতো তথ্য মেলে। বর্গফুটের হিসাব করলে বস্তির অর্ধেকেরও কম ভাড়ায় থাকা যায় ফ্ল্যাটটিতে।
এটি কেবল এই এলাকার চিত্র নয়। রাজধানীর সবখানেই একই চিত্র। নোংরা, নাগরিক সুযোগ সুবিধাহীন বস্তিতে উচ্চ ভাড়ায় থাকছে নিম্ন আয়ের মানুষ।
বস্তি নিয়ে যারা কাজ করেন, তারা বলছেন, মানসম্পন্ন আবাসন নিশ্চিত করলে বস্তিবাসী ভাড়া পরিশোধ করতে রাজি। এ ক্ষেত্রে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবশ্য দুই বছর আগে এমন একটি ভাবনার কথা বলেছেন। তিনি জানিয়েছেন, সরকার বস্তিবাসীর জন্য ফ্ল্যাট নির্মাণ করে দেবে। সেখানে দৈনিক ভাড়ায় থাকতে পারবে। তবে এখন পর্যন্ত এমন কোনো ফ্ল্যাট তৈরি করা হয়নি।
বালুঘাট নামাপাড়া প্রবাসী ভিলার সামনে দিয়ে পাঁচ মিনিট হেঁটে যেতেই সরু এক রাস্তা। রাস্তা ঠিক নয়, দুই-চারটা ইট বিছানো।
পুরোটায় আসলে স্যুয়ারেজের লাইন। মাছি ভোঁ ভোঁ করতে থাকা রাস্তার পাশে সারি সারি বেশ কিছু ঘর।
এক সারি থেকে অন্য সারির মাঝে যে জায়গা, তাতে বড়জোর দুই জন যাওয়া-আসা করতে পারবে। তার মধ্যে পড়ে আছে জমে থাকা ময়লা-আবর্জনা।
এমন পরিবেশে ৫০ বর্গফুট থেকে ১০০ বর্গফুটের একটি ঘরের ভাড়া সর্বনিম্ন দুই থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে চার হাজার টাকা।
প্রায় ২৫টি ঘরের জন্য একটা টয়লেট, গোসলখানা দুটি। বস্তির আরেক পাশে ২৩টি ঘরের জন্য টয়লেট একটি। সেখানেও গোসলখানা দুটি। রান্নাঘর নেই কোনো ঘরের সঙ্গে।
গোটা বস্তিতে রান্নাঘর তিনটি। একটিতে চুলা আছে ছয়টি করে। অর্থাৎ রান্না, গোসল, রেচন প্রক্রিয়ার জন্য লাইন ধরতে হয় নিত্যদিন।
দুই মেয়ে ও স্ত্রী নিয়ে জাকির হাসান নামে এক রিকশাচালক ভাড়া থাকেন এখানে। রংপুরে বন্যার পানিতে সব হারিয়ে ঢাকায় এসেছেন।
জাকির বলেন, ‘গতরে খাইট্টা যা কামাই, তা দুই মেয়ের লাইগাই। বিয়ার প্রথম বছর খেতা বিছাই ঘুমাইছি। এহন আল্লাহই দিলে চকি, মিরসেফ, টিভি কিনছি। তয় মাইয়্যাদের শখ আছিল সাজুগুজোর আয়নার (ড্রেসিং টেবিল)। ঘরে জায়গা নাই। তাই কিনি নাই।’
ভাড়া কত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আড়াইহাজার দেওন লাগে। তারপরে কারেন্টে, গ্যাসে তো বকশিশও দেয়া লাগে। বড়লোকগো মতো ৪/৫ হাজার টেয়া দিয়া বাসা নিতারুম না।’
জাকিরের কথা অনুযায়ী, এই এলাকায় ‘বড়লোক’ আছেন গুটিকয়েক। তাদের ঘর ১০০ বর্গফুট বা তার চেয়ে কিছুটা বড়। সেখানে খাট, মিডসেলফ, টিভির সঙ্গে আছে ফ্রিজ।
সেই ‘বড়লোকদের’ একজন আসমানি বেগম। স্বামী বাসের হেলপার।
আসমানি বলেন, ‘সাড়ে চার হাজার ট্যাকা দিয়া সাইজে একটু বড় বাসা পাইছি; এইডাই পার্থক্য। আর তো কোনো সুবিধা নাই। অই তো লাইন ধইরাই যাই বাথরুমে, রান্নাঘরে। অবশ্যি আমি সিংগেল স্টোভ কিনছি। কিন্তু সারাদিনের রান্ধা স্টোভে করা যায় না।’
এই বস্তি থেকে দেখা যায় প্রবাসী ভিলার ১৪ তলা ভবন। নিচে গ্যারেজ সুবিধা, কেয়ারটেকার, লিফট।
এখানে ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের একটি বাসায় তিনটি বেডরুম, ড্রয়িং-ডাইনিং, বড় বারান্দা, একাধিক টয়লেটসহ ভাড়া থাকেন মির্জা সাদিক আসাদ। তিনি বিমানবাহিনীতে কর্মরত। স্ত্রী ও এক মেয়েকে নিয়ে থাকেন তিনি। ভাড়া আসে ১৪ হাজার টাকা।
জাকিরের ৫০ বর্গফুটের বাসার প্রতি বর্গফুটের ভাড়া আসে ৫০ টাকা। আর জমিলার ১০০ বর্গফুটের প্রতি বর্গফুটের ভাড়া আসে ৪৫ টাকা।
অন্যদিকে সাদিকের ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের বাসায় প্রতি বর্গফুটে আসে ১১.৬৭ বা প্রায় ১২ টাকার মতো।
অর্থাৎ নাগরিক সুবিধা ছাড়াই দালান থেকেও বস্তির ভাড়া চার গুণ বেশি।
মিরপুরের কালশী, চলন্তিকা বস্তিতেও ভাড়া দুই থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা।
অভিজাত এলাকা গুলশান লেকের পরই ঢাকার সবচেয়ে বড় বস্তি কড়াইল বস্তি। সেখানে থাকেন বিউটি আক্তার। কাজ করেন মিরপুর টেকনিক্যালে প্লাজমা টেক্সটাইলে।
আড়াই হাজার টাকা ভাড়া দেয়া বাসা দৈর্ঘ্য-প্রস্থে সাড়ে পাঁচ হাত। প্রতি বর্গফুটে ভাড়া দেন ৫০ টাকা।
তিনি বলেন, ‘আড়াই হাজার টাকা দিয়া তো সুবিধা পাই না কোনো। ঘরদরের এমন অবস্থা, মনে হয় কারখানায় থাকি। এর মধ্যে, ঘরে দামি কিছু কিনি না। ভয় থাকে কবে উঠায় দেয়, নাকি পুইড়া যায়।’
গুলশান মডেল টাউনে আজাদ মসজিদ সংলগ্ন ছায়াবিথী ১০ তলা ভবন। চতুর্থ তলায় থাকেন কামরুন নাহার। বেসরকারি সংস্থায় (এনজিও) কর্মরত এই নারী তার ১ হাজার ২০০ বর্গফুটের বাসায় ভাড়া দেন ৬০ হাজার টাকা।
অর্থাৎ কড়াইল বস্তি এবং এই ফ্ল্যাটে বর্গফুটের হিসাবে ভাড়া সমান।
রাজধানীর বাড্ডা সংলগ্ন নতুনবাজার বস্তিতে গিয়ে দেখা যায়, তুমুল ঝগড়া করছেন দুই নারী। ঝগড়ার মূল বিষয় টয়লেটে কে আগে যাবেন।
একটি এনজিওর করে দেয়া তিনটি টয়লেট আছে কলোনিটিতে।
বহুতল ভবনের চেয়ে বর্গফুট হিসেবে ভাড়া বেশি এসব বস্তিতে। ছবি: নিউজবাংলা
আকলিমা-তানিয়া দুজনই পোশাককর্মী। সকাল সাতটায় থাকতে হয় কারখানায়, আশুলিয়ায়। আগেই ফ্রেশ হতে হবে।
এই কলোনির দুটি খুপড়িতে থাকেন তারা দুজন। দুজনেই দিনাজপুরের বাঘাপাড়া থেকে এসেছেন। একটা চৌকি বিছানো যাবে এমন দুটি ঘরে থাকেন তারা। কাপড় রাখেন বাজারের ব্যাগে। ভাড়া দেন ঘর প্রতি দেড় হাজার টাকা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৪ সালের সর্বশেষ বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনার তথ্য বলছে, রাজধানীর এক হাজার ৭৫৫টি বস্তিতে এক লাখ ৪৭ হাজার মানুষ আছেন। এরপর আর শুমারিও করা হয়নি তাদের নিয়ে।
নগর বস্তিবাসী উন্নয়ন সংস্থার কর্মকর্তা আবুল মালিক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘বস্তিবাসীদের উন্নয়নে সরকারি কোনো পদক্ষেপ নেই। সিটি করপোরেশনও তাদের নিয়ে ভাবে না। এটার ফায়দা লুটে স্থানীয় রাজনীতিকরা।
‘তারা এই বস্তির মানুষকে এক প্রকার জিম্মি করে রেখেছে। ভাড়া বেশি নেয়, অথচ কোনো সুযোগ-সুবিধা দেয় না।’
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বস্তি উন্নয়ন কর্মকর্তা হুমায়ন কবির বলেন, ‘বেশিরভাগ বস্তি সরকারি খাস জমিতে, কিছু রয়েছে ব্যক্তি মালিকানায়। যেহেতু মালিকানায় সিটি করপোরেশন নেই, তাই ভাড়া নির্ধারণের এখতিয়ার নেই আমাদের। আমরা করতে পারি না।’