বাড়িতে ইঁদুরের অত্যাচারে দিশেহারা অনেকেই। ঘর ইঁদুরমুক্ত করতে নেয়া হয় নিত্যনতুন কৌশল।
তবে এই ইঁদুরই সম্মৃদ্ধির পথ খুলে দিয়েছে রাজশাহীর সালাউদ্দিন মামুনের সামনে। এই প্রাণী চাষ করে মাসে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করছেন মামুন।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের ল্যাব সহকারী মামুন নিজ বাড়িতেই সীমিত পরিসরে ইঁদুর উৎপাদন করছেন। তবে এগুলো মোটেই অতি চালাক নেংটি ইঁদুর নয়।অ্যালবিনো প্রজাতির সাদা ইঁদুরের খামার করেছেন মামুন।
তার কাছ থেকে মূলত গবেষণার কাজে ব্যবহারের জন্য ইঁদুর কিনে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন সংস্থা ও গবেষকেরা।
মামুন নিউজবাংলাকে জানান, অনেকটা শখের বশেই ইঁদুর লালন-পালনের শুরু। এখন তা পরিণত হয়েছে ব্যবসায়।
শুরুটা ২০১৭ সালের শেষ দিকে। রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালীর সমসাদিপুর এলাকার নিজ বাড়িতে মাত্র চারটি ইঁদুরের বাচ্চা নিয়ে শুরু হয় মামুনের প্রাথমিক খামার।
সালাউদ্দিন মামুন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃ-বিজ্ঞান বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন ২০১২ সালে। এরপর ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অস্থায়ী কর্মচারি হিসেবে যোগ দেন।
মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা থেকে ইঁদুর লালন পালন শুরু। উদ্দেশ্য ছিল বাচ্চাগুলো বড় হলে ছেড়ে দেব। কিন্তু পরে জানতে পারি ইঁদুরের খামারও গড়ে তোলা সম্ভব।’
ইঁদুর লালন পালনের দুই মাসের মাথায় অপ্রত্যাশিত লাভের মুখ দেখেন মামুন।
নিউজবাংলাকে তিনি জানান, ২০১৭ সালের শেষের দিকে ল্যাবের সামনে বসেছিলেন। এসময় উদ্ভিদ বিজ্ঞানের এক পিএইচডি গবেষক ইঁদুরের চারটি বাচ্চা দিয়ে সেগুলোকে ছেড়ে দিতে বলেন।
ছোট বাচ্চাগুলো দেখে মায়া হয় মামুনের। কিছুদিন রেখে বড় হলে ছেড়ে দেবেন এমন ভাবনা থেকে বাচ্চাগুলো বাড়িতে নিয়ে যান তিনি।
বাড়িতে ইঁদুরগুলোকে জুতার বাক্সে রেখে কাপড় দিয়ে থাকার ব্যবস্থা করে দেন মামুন। খাবার হিসেবে দিতেন চাল, গম। এরই মধ্যে বিড়াল একটি ইঁদুরের বাচ্চা খেয়ে ফেলে। বাকি তিনটির মধ্যে একটি মাসখানেক পর ১০টি বাচ্চা জন্ম দেয়। এর সপ্তাহখানেক পরে আরও একটি ইঁদুর ১০টি বাচ্চা দেয়।
মামুন বলেন, ‘ইঁদুরের বাচ্চা দেয়ার বিষয়টি আমি বিভাগে গল্প করি। এ সময় জামার্নির এক গবেষক প্রাণিবিদ্যা বিভাগের মিউজিয়ামে ট্যাক্সিডার্মি নিয়ে কাজ করছিলেন। গবেষণার জন্য তিনি আমার কাছে ইঁদুরগুলো চাইলেন। আমি তাকে ২০টি ইঁদুর দিলাম। তিনি আমাকে এক হাজার টাকা দিলেন। টাকা পেয়ে আমি কিছুটা অবাক হলাম। এরপরই মূলত ইঁদুর পালনে আগ্রহী হয়ে উঠি।’
মামুন এখন তার বাড়ির একটি ঘরে ইঁদুর পালন করছেন। সাপ, বিড়ালসহ অন্যান্য প্রাণী থেকে রক্ষা করতে কক্ষের চারদিকে নেট লাগানো হয়েছে। ইঁদুরগুলোকে নিয়মিত চাল, গম, ভূট্টা, ডাল জাতীয় খাবার খাওয়ানো হয়।
খামারি সালাউদ্দিন মামুন
বিভিন্ন জায়গায় বিক্রির পরে বর্তমানে মামুনের খামারে ৫০টি স্ত্রী ও ৩০টি পুরুষ ইঁদুর রয়েছে। এছাড়া বাচ্চা আছে ৮০টি। প্রতিটি স্ত্রী ইঁদুর এক থেকে দেড় মাস পরপর ৮-১০টি বাচ্চা দেয়।
শুরুর দিকে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা গবেষণার জন্য মামুনের কাছ থেকে ইঁদুর কিনতেন। তবে এখন রাবি ছাড়াও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়সহ ঢাকার একাধিক ফার্মাসিউটিক্যাল ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান তার খামার থেকে ইঁদুর নিয়ে যাচ্ছে।
মামুন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘প্রথম দিকে একেকটি ইঁদুর ৪০ টাকা করে বিক্রি করতাম। এখন ৭০ টাকা দরে বিক্রি করছি। চাহিদা প্রচুর। সে অনুযায়ী সরবরাহ করতে পারি না।’
ইঁদুর পালনে সালাউদ্দিনকে সহযোগিতা করেন তার বাবা বেলাল উদ্দিন। ব্যতিক্রমী এই খামারি বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর ভ্যাক্সিন তৈরির চেষ্টা করছে এমন একটি দেশীয় প্রতিষ্ঠান সম্প্রতি আমার কাছ থেকে ৫০টি ইঁদুর নিয়েছে। অন্যান্য অনেক প্রতিষ্ঠান নিয়মিত ইঁদুর নিচ্ছে। ’
গবেষণার জন্য দুই বছর ধরে মামুনের খামার থেকে ইঁদুর নিচ্ছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক আবু রেজা।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মানুষের জিনের বেশ মিল থাকায় গবেষণার প্রাথমিক পর্যায়ে অ্যালবিনো প্রজাতির ইঁদুরের বেশ চাহিদা রয়েছে। ব্যক্তি উদ্যোগে ইঁদুর পালনে আগ্রহীদের সরকারিভাবে প্রশিক্ষণ দিতে পারলে তা বাংলাদেশের গবেষণাখাতকে সমৃদ্ধ করবে।’
ইঁদুরের বংশ বিস্তার নিয়ে কাজ করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ রসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জাহাঙ্গীর আলম সাউদ।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ব্যক্তি উদ্যোগে ইঁদুর পালন একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। সালাউদ্দিন মামুন বাণিজ্যিকভাবে ইঁদুর পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন। এক্ষেত্রে বাসস্থান, খাবার ও তাপমাত্রার মতো বিষয়গুলো আরও বৈজ্ঞানিকভাবে নিশ্চিত করা উচিত। ’